
ছবি : নিজস্ব
সিলেটে এক নামেই পরিচিতি তাঁর। নাম মিজান আজিজ চৌধুরী সুইট। কর্মচঞ্চল এই মানুষটির চারদিকে এখন ঘোর অন্ধকার। সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। শুধু নেই দৃষ্টিশক্তি। গত ৩ বছর হলো তিনি চোখে দেখতে পারছেন না। কিন্ত স্বপ্ন থেমে নেই। ৩’শ অনাথ শিশুর জন্য একটি এতিমখানা গড়ে তুলছেন। এখন একটাই চাওয়া-যেন সেই এতিমখানাটির বাস্তব রূপ দেখে যেতে পারেন।
নগরের কুয়ারপারের মরহুম আব্দুল আজিজ ফরিদ চৌধুরীর জ্যেষ্ট সন্তান তিনি। ফরিদাবাদ নামেই বাড়ির নাম। সিলেট নগরের ধোপাদীঘির পারের ওসমানী শিশু পার্কের কর্ণধার তিনি। তাঁর একক উদ্যোগ আর প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠে শিশুদের এ বিনোদন কেন্দ্র। জাফলংয়ে পাথর ব্যবসা করেছেন দীর্ঘদিন। সেখানে পাথরের ডাস্ট থেকে উচ্ছিষ্ট ময়লাকে রূপান্তর করে টাইলস বানানোর ‘ নেপথ্য কারিগর’ তিনি। পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস কোম্পানীগঞ্জে। সেখানে তাদের পূর্ব পুরুষদের জমিদারী ব্যবসা ছিলো। তাঁর পিতামহ আব্দুল হামিদ চৌধুরী সেখানে জমিদার ছিলেন। ৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে সবার সবার বড় সুইট ব্যক্তিগত জীবনে চার কন্যা সন্তানের জনক মিজান আজিজ সুইট এখন পুরোটাই ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর বড় মেয়ে তাসনিয়া মিজান চৌধুরী শাবিতে অধ্যাপনা করছেন। অন্যরা লেখাপড়ায় ব্যস্ত।
সোমবার যখন তাঁর খোঁজে ছুটলাম তখন বেলা বারোটা। জানলাম তিনি ক’দিন আগে ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এখন বাসায় নেই। পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গেলাম। কেবিনে ঢুকতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। এতদিন যে প্রাণবন্ত মানুষটিকে দেখলাম এতিমের বিয়ে দিতে। যে মানুষটিকে দেখলাম কুয়ারপারের এক গরীব মেধাবী শির্ক্ষার্থীর কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করতে এখানে ওয়ানে দৌড়াতে , বিভিন্ন জনের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাততে। সংবাদ সম্মেলন করে বলতে দেখেছি আপনারা যারা যা পারেন মেয়েটিকে সাহায্য করেন। যদি তাঁর কিডনী প্রতিস্থাপন করতে আরও টাকা যা লাগে আমি দেব। মানবিক গুণাবলীর অনন্য উদাহরণ সেই মানুষটি নির্বাক হয়ে হাসপাতালের বেডের পাশে একটি চেয়ারে বসে আছেন। চেয়ারের পেছনে দাড়িয়ে বার বার নিচের চোখের জল মুচছেন অর্ধাঙ্গিনী। আর আরেকজন মুখ মুছে দিচ্ছেন। নিজের জীবন সঙ্গীর এমন অবস্থার কথা হয়তো কখনও কল্পনাও করেননি মিজান আজিজ সুইটের সহধর্মিনী শাহনাজ আক্তার চৌধুরী। তাই তিনিও বারবার অপলক দৃষ্টিতে প্রিয় মানুষটির দিকে থাকিয়ে থাকেন। আর এমনি করেই বুঝি চোখের জল ফেলেন। নাম পরিচয় বলতেই ‘সুইট ভাই’ হাত বাড়ালেন। বললেন সব আল্লাহর ইচ্ছা। আমিও বললাম তাই। জানলাম এক সপ্তাহ ধরে এখানে চিকিৎসাধীন আছেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। লাঞ্চে ইনফেকশন হয়েছে। প্রফেসর ডা. শিশির বসাক ও প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলামের তত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন।
এরপর দীর্ঘক্ষণ কথা হলো মিজান আজিজ চৌধুরী সুইটের সঙ্গে। এক সময় যার কন্ঠ বক্তৃতা বা আলাপচারিতায় মাধূর্য ছড়াতো সেই মানুষটির মুখের কথা যেন কানে এসে পৌছতেও সময় লাগছে। জিহবায় আটকে যাচ্ছে কথা গুলো। কারণ তিনি শুধু চোখের রোগী নন। স্ট্রোক করেছেন। বর্তমানে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সর্বপ্রথম মিজান আজিজের নাম সিলেট নগরে স্ব গৌরবে উচ্চারিত হয় ১৯৭৮ সালে। তখন তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে সিলেট স্টেডিয়ামে এক অসাধারণ ক্রিড়া নৈপুন্য প্রদর্শণ করেন। গোল ঘওে দ্রুতবেগে মোটর সাইকেল চালিয়ে ডেঞ্জার গেম দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। তখন তিনি পরিচিতি পান ‘ডেঞ্জার মাস্টার’ হিসেবে। এরপর সিলেট ওসমানী শিশুপার্কে বিভিন্ন সময়ে তিনি এই ডেঞ্জার গেইম রাইড পরিচালনা করে দর্শকদের মাঝে আলোচিত হন। আর জীবনে আরেকবার ব্যাপক আলেচিত সিলেট নগরের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রথমবার আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র হবার পর। সিলেট নগরের জলাবদ্ধতার উদাহরণ খ্যাত গাভিয়াল খাল পরিস্কার করে সেখানে মেয়রকে নিয়ে বোট চালান। বদ্ধ খালটির পানি প্রবাহের ধারা সৃষ্টি করে নজির দেখান। মিজান আজিজ চৌধুরীর দাবি তিনি এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর নিজস্ব ৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন।
মিজান আজিজ সুইট সিলেটে অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, বিশেষ করে সিলেট কুষ্ঠু হাসপাতাল, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দীর্ঘদিনের সহযাত্রী তিনি।
মিজান আজিজ চৌধুরীর স্ত্রী শাহনাজ আক্তার চৌধূরী জৈন্তাবার্তাকে জানালেন, ২০২০ সালের ১৫ জুলাই অন্য দিনের মতো ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী মিজান আজিজ চৌধুরী সুইট। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দূপুর যায়। ঘুম থেকে উঠছেন না। বারবার নাস্তার টেবিলে ডাক পড়ছে। কিন্ত সাড়া নেই। এক পর্যায়ে চিৎকার দিয়ে উঠেন সুইট। বলেন, আমি কিছুই খেতে পারছিনা। তখন দেখা যায় শরীরে প্রচন্ড জ্বর। পরিচিত একজন ডাক্তারের কাছে অবস্থা জানিয়ে ফোন করেন শাহনাজ চৌধুরী। তাদের পরামর্শে ঘরেই রাখা হয়। পরদিন হাসপাতালে নিয়ে যান। করোনা পরিস্থিতির মাঝেও চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেন। একটি ইনজেকশনের নাম লিখে দেন। কিন্তু সে সময় এই ইনজেকশনটি সিলেট-ঢাকা তথা দেশের কোথাও মিলেনি। আর এমনি পরিস্থিতিতে এক অসহায় অবস্থার মুখোমুখি হন সুইট পরিবার। চিকিৎসা চলতে থাকে । মুহুর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ে নিকটজনদের মাঝে। দেশ বরেণ্য চিকিৎসক ডাক্তার জিয়া, ডা. বিমল, ডা. জিন্নুরাইনসহ সুইটের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকরা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালান। চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ড এবং ভারতের চিকিৎসকদের স্মরণাপন্নও হন তারা। কিন্ত কোনো কিছুতেই আর চোখের জ্যোতি ফেরেনি। প্রায় তিন বছরের অধিক সময় পার হতে চলল, কিন্তু আজও কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি চিকিৎসা। উল্টো ঘরবন্দি অবস্থায় নানা রোগ বালাই এখন বাসা বাঁধছে স্বপ্নবান এই মানুষটির দেহে।
অসুস্থ হলেও স্বপ্ন ঠিক আগের মতোই দেখেন মিজান আজিজ চৌধূরী। বললেন, জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নের বাস্তবায়ন চলছে এখন। সিলেট শহরতলীর ছালিয়ার মহল এলাকায় একটি এতিমখানা গড়ে তুলছেন। যেটির কাজ চলছে পুরোদমে। যেখানে ৩’শ এতিম আশ্রয় পাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। আরও তিনটি মসজিদ এর আগে নির্মাণ করেছেন। ২০/২৫টি মসজিদ মাদরাসার সংস্কার, সৌন্দর্য বর্ধন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজে নিজেকে আজীবন সম্পৃক্ত রেখেছেন । এগুলো তার মনের মধ্যে অনেক তৃপ্তি দেয়। জীবনে কয়েকবার হজ্বব্রত পালন করেছেন। ইউরোপ আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের এমন দেশ খুব কমই আছে-যেখানে তিনি যাননি।
তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে আমেরিকায় থাকার সুযোগ পেয়েও দেশে ফিরে আসেন। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি টান ছিলো। এখানে কিছু করার স্বপ্ন দেখেন তখন থেকেই। এরপর থেকে দেশে একের পর এক চমকপ্রদ উদ্যোগ নেন। আর ব্যবসা বানিজ্যে সাফল্য আসতে থাকে। আর নিজের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকে যে কাজেই হাত দিয়েছেন সেখানে সফল হয়েছেন।
জীবনেতো অনেক কাজ করেছেন,এখন কেমন আছেন? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মিজান আজিজ একটা দীর্ঘশ^াস ফেলে বলেন, একটা পিঁপড়া তার দ্বিগুণ ওজনের কিছু বহন করতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি সেই পিঁপড়ার তুলনায়ও কিছু করতে করতে পারিনি। তিনি সকলের কাছে দোয়া চান।
এম সি
