ইফতারি প্রথাকে ‘না’ বলি
শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৬

ইফতারি প্রথাকে ‘না’ বলি

কলাম লেখক

প্রকাশিত: ১২/০৩/২০২৪ ১২:৪১:১০

ইফতারি প্রথাকে ‘না’ বলি

ইফতারি প্রথাকে ‘না’ বলি।


তাকওয়ার মাস রমজান। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। কোরআন নাজিলের মাস রমজান। শবে কদরের মাস রমজান। জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস রমজান। জান্নাত লাভের মাস রমজান। রমজানে অনতিবিলম্বে ইফতার করা সুন্নত। রোজাদার কোন ব্যাক্তিকে ইফতার করানো নি:সন্দেহে ছওয়াবের কাজ। 

সমস্তদিন কোন ব্যক্তি রোজা রেখে ইফতাররের মাধ্যমে যে ছওয়াব অর্জন করেন, সমপরিমাণ ছওয়াব সে অর্জন করতে পারে অন্য রোজাদার মানুষকে ইফতার করানোর মাধ্যমে। যদি আমাদের কারো সামর্থ থাকে এবং কোন রোজাদার ব্যক্তিকে ইফতার করানোর সুযোগ পাই, তাহলে, সুযোগটি আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের সমাজে এই সুযোগটিকে অনেকে লোক দেখানো, নাম কামানো তে ব্যবহার করেন। যা খুবই দু:খজনক। 

ইফতার ইসলামের একটি ইবাদাত। কিন্তু এই ইবাদাতকে আমরা অনেক ক্ষেত্রে অভিশাপে পরিনত করতে যাচ্ছি। যেমন, মেয়ের বাড়ি বেশি ইফতার পাঠালে মেয়ের মুখ উজ্বল হবে এমন একটি প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত। মাহে রামাদানকে কেন্দ্র করে সমাজে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ইফতারি প্রথা নামের সমাজিক ব্যাধি। মেয়ের বাবা ও মায়ের ঘুম নষ্ট করে দেয় এই ব্যাধি। 

আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে মেয়ের শ্বশুর বাড়ীর ইফতারি নামক এক সামাজিক নিরব অবিচার। শুধুমাত্র অবিচারই নয় একটা প্রচলিত কুসংস্কার বটে। আমাদের সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই(মেয়ের শ্বশুর বাড়ীর ইফতারি) কুসংস্কার সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস ঈমানের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইসলামে কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। যুগ যুগ ধরে এই অবিচারের বলি হয়ে আসছে একটা মেয়ের বাবা বা তার অভিভাবক। একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবার জানে এই কুসংস্কারের বলি হয়ে তারা কতটা জর্জরিত। 

আমরা সমাজের এক শ্রেণির লোক এগুলোকে সংস্কৃতিতে রূপ দিয়েছি। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির ইফতারির নামে প্রবণতা এক ধরনের জুলুমের শামিল। আর জুলুম আল্লাহ তাআলার দরবারে ভয়াবহ অপরাধ। বিশেষ করে আমাদের সিলেট বিভাগে ইফতার করানোর নামে ‘ইফতারি‘ দেয়া একটি ব্যাধিতে রুপান্তরিত হয়ে গেছে। এখানে একটি প্রথা প্রায় চালু আছে যে, কারো সামর্থ থাকুক আর না-ই থাকুক, প্রতি বছর রমজান মাস আসলে মেয়ের বাড়ী ইফতারি দিতেই হবে। না দিলে যেন ইজ্জত যায়! অর্থাৎ এখানে ইফতার দেয়াকে সামাজিক দ্বায়িত্ব এবং গ্রহন করাকে গৌরবের ভাবা হচ্ছে। যদিও ঢালাও ভাবে এই কথাটি সবার জন্য সঠিক নয়। 

যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে মেয়ের শ্বশুর বাড়ীর ইফতারি নামক এক সামাজিক নিরব অভিচার। শুধুমাত্র অভিচারই নয় একটা প্রচলিত কুসংস্কার বটে। এই প্রথার কোন ধর্মীয় ভিত্তি নেই। মানুষের তৈরি যুক্তিহীন প্রথাকে সহজ বাংলায় কুসংস্কার বলা হয়। এই কুসংস্কার আমাদেরকে এমন বর্বর বানিয়েছে যে, অনেক মহিলাকে মেয়ের বাড়ি ইফতারি পাঠানোর জন্যে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিতে আমার নিজ চোখে দেখেছি৷ কাতর হয়ে বলতে শুনেছি, মেয়ের বাড়ি ইফতারি না পাঠালে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থাকতে পারবে না৷ শারীরীক এবং মানসিক অত্যাচার সইতে হবে মেয়েটাকে৷ আরো কত কি!

যুগ যুগ ধরে এই অভিচারের বলি হয়ে আসছে মেয়ের বাবা বা তার অভিভাবক। ইফতারি প্রথাকে কুসংস্কার বলতে একটু ও কার্পন্য করতে পারিনা, কারন এটা সমাজের জন্য অশান্তি। কোন রকমের অশান্তি সংস্কৃতির অংশ হতে পারেনা। সংস্কৃতি হচ্ছে সুন্দর ও হক পক্ষের কর্ম। যে সমাজের সংস্কৃতি যত সঠিক এবং উন্নত সেই সামাজে বেশি প্রশান্তি বিরাজ করে। সমাজের শান্তির জন্য অন্তত এই ব্যাধি দূর করতে হবে। 

রমজান মাস এলে অনেক মেয়র পিতা-মাতাগণ খুবই পেরেশানিতে দিনগুলো অতিবাহিত করেন। যেকোন মূল্যে ইফতার পাঠাতে হবে না হয় মেয়ে মুখ দেখাতে পারবেনা ! এমন পরিস্থিতিতে কখনো ঋণ করে কখনো সুধের মাধ্যমে কখনো ঘরের বলদ বিক্রি করে। অনেক মহিলাকে মেয়ের বাড়ি ইফতারি পাঠানোর জন্যে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। কিছু মানুষ চরম অন্ধবিশ্বাস যে মেয়ের শ্বশুর বাড়ীর ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ কে লালন করে। অনেকের শ্বশুরবাড়ি হয়ত অনেক পয়সাওয়ালা৷ তাদের জন্যে এসব কিছুই না৷ দরিদ্রদের অবস্থা কি হবে? 

অনেক গরিব বাবার মেয়ে আছে কয়েকজন তিনি কি করবেন? এটা ভেবে দেখার বিষয়। কিন্তু এই কুসংস্কার আমাদেরকে এমন বর্বর বানিয়েছে যে যদি ইফতার না দেয়া হয় তাহলে আমরা মেয়েকে গালাগাল দেই নির্যাতন করি। আমাদের সমাজে সিংহভাগ মানুষ নিন্মমধ্যবিত্ত অথবা দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে। সমাজের এই মানুষগুলোই ইফতারী দেয়ার প্রথাকে সম্পাদন করতে কত যে হীমসিম খাচ্ছে তা ভেবে দেখা উচিত। স্বামীর বাড়ী মেয়ের ইজ্জত বৃদ্ধিসহ জামাই, শশুর,শাশুড়িকে বেশী খুশী করতে যতটুক ইফতারি প্রয়োজন তার চেয়ে তিন-চারগুন বেশী ইফতারি নিয়ে মেয়ের বাড়ীতে অনেকে হাজির হন। 

ইফতারির ক্ষেত্রে আরেকটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে, ইফতারি কী দিয়ে নিয়ে যাবেন৷ মাইক্রো ভাড়া করবেন, না পিকআপ ভ্যান ভরে নিয়ে যাবেন? যত বড় পরিবহন ব্যবহার করা হবে। বিয়াই বাড়ির এলাকায় তাদের মুখ ততো বেশি উজ্জ্বল হবে৷ এসবই অসুস্থ মানসিকতা৷ আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই ঠেলা গাড়ি, ট্রাক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় মূলত জামাইর বাড়ির আশপাশের লোক দেখানোর জন্য-ই করা হয়ে থাকে।

রমজান মাস হলে বাবার বা অভিভাবকের চিন্তা বাড়তেই থাকে। মেয়েকে/বোন কে কিভাবে ইফতারি দেবে। ভাল করে ইফতারি না দিলে মেয়েকে শশুরবাড়ি আর আশপাশের কটুকথা শোনতে হবে। আমরা আধুনিক আর সভ্যতার জয়গান করছি,তবে মেয়ের বাবার প্রতি এই অভিচার কেন। ইফতার করানো সুন্নত সেই সুন্নতের উপর আমল করা কি শুধু মেয়ের পিতা-মাতার উপর? আর ছেলের পিতা-মাতারা কি শুধু খাবেন? একতরফা রীতি ইসলাম সমর্থন করেনা। ইসলামের কোথাও মেয়ের শশুড় বাড়িতে ইফতার পাঠানো বাধ্যতামূলক বলে উল্লেখ নেই। তবে আপনজনকে নিয়ে ইফতার করা আর বাধ্যতা মূলক ইফতারি প্রথা এক নয়। মেয়ের বাবা নিজ উদ্যোগে যদি হালকা ইফতারি নিয়ে মেয়ের বাড়িতে জামাই,বিয়াই -বিয়াইনদের সাথে ইফতার করেন সেটা সম্পূর্ণ আলাদা। 

তাই আসুন, আমাদের সমাজের ঐসব কু-প্রথার বীজ এমন ভাবে রোপণ হয়েছে যার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে হলে প্রত্যেক বিবাহিত ছেলেদের এগি আসতে হবে। ছেলে পক্ষ থেকে মেয়ে পক্ষকে জানিয়ে দিতে হবে, ইফতারির এই সংস্কৃতি বন্ধ করুন। এটি একটি কুসংস্কার৷ সামাজের প্রতিটি মানুষকে-ই সোচ্চার হতে হবে। আর সেটা শুরু করতে হবে নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শীর মধ্য দিয়ে।

লেখক: আবু জাফর শিহাব (এল এল বি)।

জৈন্তাবার্তা/জেএ