ড. আতিউর রহমান
নিঃসন্দেহে বিশ্ব এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বীকার করতেই হবে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে জাহাজের খরচ বেড়েছে। ফলে যেকোনও পণ্য আদান-প্রদান ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। যারা আমদানি ও রফতানি করে তাদের উভয়ের জন্য সমস্যা তৈরি করছে। তবে সমস্যাটা আমদানিকারকদেরই বেশি হয়েছে।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতি বিপদসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রত্যেকটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পলিসি রেট বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই সুদের হার বেড়েছে। মুদ্রানীতি অনেকখানি সংকোচনমুখী হয়েছে। ফলে ওই সব দেশের ট্রেজারি বন্ডগুলোর রিটার্ন বেড়ে গেছে। ওইসব দেশের বিনিয়োগকারীরা, যারা আমাদের মতো বা উন্নয়নশীল দেশের শেয়ার বাজারে কিংবা এফডিআই হিসেবে বিনিয়োগ করেছিল, তারা ওই বিনিয়োগগুলো উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ফিরিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। এই কারণে ডলার শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে আমাদের টাকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার দাম কমে গেছে।
আমাদের টাকার বিনিময় হার গত দুই বছরে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো কমে গেছে। একদিকে সরাসরি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যে যন্ত্রপাতি কিনি সেটার দামও বেড়ে গেছে। এগুলো দিয়ে যখন আমরা উৎপাদন করি সে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। আর জ্বালানি তেল দিয়ে আমরা যে বিদ্যুৎ তৈরি করি তারও দাম বেড়ে গেছে। ডিজেলের খরচ বেড়ে যাওয়ার মানে আমাদের পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। এছাড়া বিদেশে কোনও পণ্যের দাম যদি বেড়ে যায়, সেই পণ্য দেশে উৎপাদন করা হলেও দাম বাড়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
মূল্যস্ফীতি একদিকে সরবরাহ সংকটের কারণে বেড়েছে। অন্যদিকে আরেকটি বড় কারণ চাহিদা বেড়ে যাওয়া। মনে রাখা চাই, কোভিডকালে আমরা প্রচুর প্রণোদনা দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আমরা সাধারণ উদ্যোক্তাদের দিয়েছি। যেমন ২ শতাংশ সুদ হারে টাকা দিয়েছি উদ্যোক্তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য নানারকম কার্ড তৈরি করা হয়েছে। কম দামে সুবিধাবঞ্চিতদের চাল-ডাল-তেল সরবরাহ করা হয়েছে। এখনও দেওয়া হচ্ছে অনেককে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য রাজস্ব খরচ বেড়ে গেছে। সেই খরচ মোকাবিলা করতে সরকারকে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রচুর ঋণ করতে হয়েছে। এসব মিলিয়ে বাড়তি টাকা ঢুকে গেছে বাজারে। অথচ বাড়তি উৎপাদন হচ্ছে না। তাহলে যা হয়, বাজারে যখন অনেক বেশি টাকা থাকে আর পণ্য যদি সেভাবে উৎপাদিত না হয়, তাহলে তো মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবেই। তার মানে দেশি-বিদেশি দুটো কারণেই কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। শুধু বিদেশিদের দোষ দেওয়া ঠিক হবে না।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার আরেকটি কারণ রাজস্ব নীতি। বিদেশি পণ্য যেগুলো আসছে, আগেই বলেছি যে সেগুলোর দাম ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তার মানে সরকারেরও কিন্তু ৩০ শতাংশ শুল্কের হার বেড়ে গেলো। এখন যেহেতু টাকার অঙ্কে এটা বেড়ে গেছে, উচিত ছিল এই টাকাটা পুরোটা সরকার না নিয়ে খানিকটা ভোক্তার সঙ্গে শেয়ার করা। ধরা যাক, আমি যদি ৩০ টাকা বেশি শুল্ক পেয়ে থাকি ভোজ্যতেলে তাহলে সেটা আমি কমিয়ে দেবো। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য কমানো হয়েছে কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। যে কারণে জিনিসপত্রের দাম বেশিই রয়ে গেছে। আবার হয়তো কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত করেছে এনবিআর। তবে যিনি আমদানি করেন তিনি আর এটা মার্কেটের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করেননি। তাই বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটি দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কতিপয় তন্ত্রের কারণে ভোগ্যপণ্যের বাজারে দামের এই অস্থিরতা আরও বেশি।
অন্যদিকে যতটা রাজস্ব আমাদের আদায় করার কথা, আমরা কিন্তু সেই পরিমাণ আদায় করি না বা করতে পারি না। কর দেওয়ার মতো এক কোটি মানুষ টিন নম্বর সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু মাত্র ৩০ লাখের মতো মানুষ সত্যি সত্যি রিটার্ন দেন, কিন্তু বাকিরা কই? তারা হয়তো দাবি করেন তাদের অত আয়-রোজগার নেই। আসলেই কি তাই? এটা খোঁজার জন্য দুইটা উপায় আছেÑএকটা হলো রাজস্ব বিভাগের যদি জনশক্তি বাড়ানো যেতো, যদি উপজেলা পর্যন্ত তাদের ব্রাঞ্চ খোলা যেতো, তারা হয়তো সেখানে একটা খবর নিয়ে কাজ করতে পারতো। দ্বিতীয় যেটা করতে পারতো সেটা হলো অফিস না খুলেই ডিজিটাল যুগে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে কিন্তু জানা সম্ভব এই উপজেলায় কতজন কর দেওয়ার মতো মানুষ আছেন। আর একটি উপায় হলো, এমন কিছু খাত আছে যেখানে নতুন করে কর বসানোর সুযোগ এখনও আছে। যেমন, আমাদের ছেলেমেয়েদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তামাকপণ্য গ্রহণ করার কারণে। আমরা চাই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ। তাহলে সিগারেটের দাম আমরা বাড়াই না কেন? এক শলাকা সিগারেট বিক্রি করার সুযোগই আমি রাখবো না। আর যদি কেউ সেটা কিনতে চায়, তাহলে তার দাম অনেক বেশি বাড়িয়ে দিতে হবে। দাম যদি বাড়িয়ে দেই, তার ওপর আমরা যদি স্পেশাল ডিউটিও বাড়াই, তাহলে একটা হিসাব করে দেখেছি যে সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর আমরা পেতে পারি। এভাবে নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলো যদি টার্গেট করি তাহলে রাজস্বের পরিমাণ নিশ্চয় আরও বাড়াতে পারি। এসবের পাশাপাশি নাগরিকদের কর প্রদানে উৎসাহিত করতে জাতীয় পর্যায়ে প্রচারাভিযানের কথাও ভাবা যায়।
এই প্রেক্ষাপটে আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হতে যাচ্ছে, তা নানা কারণেই বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। রিজার্ভ ক্ষয়রোধ এবং মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের বাজেটকে অবশ্যই সংকোচনমুখীই হতে হবে। গণমাধ্যমে যে খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হয় বাজেট-প্রণেতারা সে পথেই এগোতে চাচ্ছেন। সেটিই কাম্য। আমরা ইতোমধ্যে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছি। ফলে মুদ্রানীতি ও বাজেটের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় তো নিশ্চিত করতেই হবে। তবে কোনও অবস্থাতেই ভুলে গেলে চলবে না যে জনগণের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করাই বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই আসন্ন বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার সংকোচনমুখী নীতি গ্রহণ এবং অস্থির অর্থনৈতিক বাস্তবতায় জনস্বার্থ রক্ষার জন্য গণমুখী রাজস্ব প্রস্তাব প্রণয়ন- এ দুইয়ের মধ্যে একটি কাক্সিক্ষত ভারসাম্য বজায় রাখতে দারুণ মুন্সিয়ানা দেখাতে হবে আমাদের বাজেটপ্রণেতাদের।
গত জুনে (জুন ২০২৩-এ) চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবেও কিছুটা সংকোচনমুখী রাজস্ব নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এবারের জুনের বাজেট অধিবেশনে চলতি বছরের বাজেট বাস্তবায়নে ওই সংকোচনমুখিতা কতটা বাস্তবায়ন করা গেছে এবং তার ফলাফল কী হয়েছে তা নিয়ে নীতিনির্ধারকরা মতবিনিময় করবেন। প্রত্যাশা থাকবে- চলতি বছরের অভিজ্ঞতার কার্যকর প্রতিফলন ঘটবে আসছে অর্থবছরের প্রস্তাবনায়। আসছে বছরে খুব সম্ভবত বাজেটে কাটছাঁটের ওপর আরও বেশি জোর দেওয়া হবে। সেটা প্রত্যাশিতও বটে। তবে আমার মনে হয় কোনও ঢালাও নীতি গ্রহণের সুযোগ এখানে নেই। নতুন করে বড় অবকাঠামো প্রকল্পে হাত না দেওয়ার বার্তাটি অবশ্যই বাজেট বক্তৃতায় আশা করবো। কেননা, রিজার্ভ ক্ষয় ঠেকাতে নতুন করে বড় প্রকল্প না নেওয়াই কাম্য। তবে যেসব বৃহৎ প্রকল্প চলমান সেগুলোর বরাদ্দে কাটছাঁট নয়, বরং এগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে তাগিদ থাকতে হবে। কারণ বিদ্যমান সামষ্টিক-অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আমদানি যতটা সম্ভব কমাতে হবে। সে জন্য দরকার শিল্প খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ যতটা সম্ভব অনুকূল করে তোলা। সেটা করতে হলে চলমান ছোট-বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করার বিকল্প নেই।
বাজেটে কাটছাঁটের প্রসঙ্গে আরেকটু আলোকপাত করতে চাই। আগেই বলেছি উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁটের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। খাতভিত্তিক কাটছাঁটের সময় আলাদাভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোর দিকে বিশেষ নীতি-মনোযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সম্পদ নিঃসন্দেহে সীমিত। তবু এ দুটি খাতে কাটছাঁটের প্রভাব যত কম ফেলা যায় ততই ভালো। স্বাস্থ্যে বরাদ্দ যতো বাড়ানো যাবে স্বাস্থ্য বাবদ জনগণের আউট-অব-পকেট কস্ট ততই কমবে। ব্যাপক মূল্যস্ফীতির এই বাজারে জনগণের স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করা দরকার। একইভাবে শিক্ষায় বরাদ্দের সঙ্গে আমাদের জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সর্বোপরি বিদ্যমান অর্থনৈতিক অস্থিরতাকালে সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দও যতটা সম্ভব বাড়াতেই হবে। কাজেই এসব সামাজিক খাতে বরাদ্দ না কমিয়ে বরং অন্যান্য খাতে সাধারণত বাজেটের যে অংশটুকু অব্যয়িত থাকে সেগুলোও এসব খাতে বিনিয়োজিত করার কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। অনেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা কম হওয়ার কারণ দেখিয়ে এসব খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিপক্ষে থাকেন। আমি মনে করি বাস্তবায়ন দক্ষতাই যদি ইস্যু হয় তাহলে সেই দক্ষতা বাড়ানোর জন্য হলেও এসব খাতে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া চাই। বাস্তবতার নিরিখে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের বাজেটে নিশ্চয় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী প্রস্তাবনা সামনে আনতে হবে। তবে বাজেটপ্রণেতারা এক্ষেত্রে সামষ্টিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নকেও সমান অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনায় রাখবেন বলে আমরা আশা করি।
এলএইচ