ছবি: নিজস্ব
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বিদ্যাপীঠ মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ নগরীর টিলাগড় এলাকায় ১২৪ একর জায়গার ওপর অবস্থিত। কলেজটি প্রতিষ্ঠার ১৩১ বছর পার হতে চললেও মুরারিচাঁদ কলেজ ক্যাম্পাসে নেই একটি ‘মুক্তমঞ্চ’। ফলে সহজে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চর্চা করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে কলেজটির শিক্ষার্থীরা। দেশের ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির ধারা বজায় রাখতে মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠা এখানকার শিক্ষার্থীদের সময়ের দাবি। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা মুক্তমঞ্চ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর সিদ্ধান্ত আসেনি।
সময়ের পরিক্রমায় কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার্থীদের বিচরণ তথা আড্ডা, গল্প, গান বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বৃহৎ পরিসরে আয়োজনের জন্য নিদিষ্ট মুক্তমঞ্চ নেই। কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বড় কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে জায়গা সংকটে বেগ পোহাতে হয় আয়োজকদের। মুক্তমঞ্চ হলে একদিকে যেমন কলেজের অডিটোরিয়ামের ওপর চাপ কমবে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। এতে পড়াশোনার একঘেয়েমি কিছুটা হলেও কাটবে শিক্ষার্থীরাও কলেজমুখী হবে। আর সেই সুযোগ করে দিতে কলেজ প্রশাসন দ্রুত মুক্তমঞ্চ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সিলেটের শতবর্ষী মুরারিচাঁদ কলেজটি এমসি কলেজ নামেই সুপরিচিত। ১৮৯২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র রায় এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজের লাইব্রেরিতে প্রায় ৬০ হাজার বই আছে। সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে অন্তত ২০টি সংগঠন। মোট শিক্ষার্থী প্রায় ১৪ হাজার। উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি এখানে স্নাতক (পাস), ১৫টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৬টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। শিক্ষক আছেন ১৩০ জন। সুবিশাল ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি মসজিদ, ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হোস্টেল, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন এবং একটি খেলার মাঠ। একটি করে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জুলজিক্যাল মিউজিয়াম আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা রাজা গিরিশচন্দ্র রায়, সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া এঁর ম্যুরাল রয়েছে।
কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে থিয়েটার মুরারিচাঁদ, মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ উল্লেখযোগ্য। থিয়েটার মুরারিচাঁদ নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন, নাট্য কর্মশালা আয়োজন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসব। মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মোহনা বসন্তবরণ উৎসব’, ‘মোহনা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা’, ‘লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’। মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ 'মুরারিচাঁদ কলেজ বইমেলা', ‘৫২ প্রশ্নে ২১ পুরস্কার' কুইজ প্রতিযোগিতা’, ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘জাগরণ’ প্রকাশ, ‘শরৎ কবিতা উৎসব’ এসব সংগঠন দিনব্যাপী কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্যাম্পাস মুখর করে রাখে। পহেলা বৈশাখ, বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দেখা যায় কলেজ প্রশাসনকে। এছাড়াও কলেজের ১৬টি বিভাগের প্রায় প্রতিটিরই একটি করে ক্লাব আছে। ক্লাবগুলোও আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠান।
সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানায়, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও অনলাইন জগতকে যখন নিতান্ত আপন করতে ব্যস্ত সবাই তখনও তারা বাঙালি সংস্কৃতি সবার মাঝে তুলে ধরার মাধ্যমে আনন্দঘন কিছু সময় উপহার দিতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু ছোটখাটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গেলেও তাদের অনেক বেগ পোহাতে হয় বলে অভিযোগ করে তারা। যেখানে একটি মঞ্চ তৈরি করতেই ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান করাটা আর্থিকভাবে অনেকটা ভাবায়। ফলে তাদেরই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে না তারা। তাই একটি মুক্তমঞ্চ স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন কলেজের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল আনাম মোঃ রিয়াজ জানান, শতবর্ষী ভবন সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবিতে কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন ভিপি ও এজিএস কিছুদিন আগে একটি স্মারকলিপি প্রদান করে গিয়েছিল সেই স্মারকলিপির সাথে একটি মুক্তমঞ্চের কথা যুক্ত করে আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠিয়েছি। কলেজের ‘আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ’ এর নিদর্শন বাংলা ও সমাজবিজ্ঞানের পুরাতন টিনসেড ভবন দুটির মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটিতে সাংস্কৃতিক মুক্তাঙ্গন করার ইচ্ছা রয়েছে। তাহলে কলেজের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পাবে আর সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বাড়বে। আমরা আশাবাদী কলেজের সকল পুরাতন ভবনগুলো না ভেঙ্গে টিনসেড ভবনগুলো আসাম টাইপে সংস্কার কাজ ও একটি মুক্তমঞ্চ দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ কররেন। তিনি আরো জানান সিলেট-১ আসনের এমপি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে আব্দুল মোমেন উনি এই বিষয়ে আমার সাথে একবার কথা বলেছিলেন তিনি সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আমি আশা করি এমপি মহোদয় যদি জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে কথা বলেন তাহলে দ্রুত কার্যকর হবে।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. সাহেদা আখতার জানান, দেশের নবম শতবর্ষী মুরারিচাঁদ কলেজ। এ কলেজ জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার এক অনন্য কেন্দ্রস্থল হিসেবে এতদঞ্চলে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে চলেছে। সাহিত্য, সংস্কৃতিচর্চায়ও রয়েছে মুরারিচাঁদ কলেজের সোনালি অতীত। সমৃদ্ধ অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও এ কলেজে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকমণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে ৯ টি কেন্দ্রীয় সংগঠন ও বিভাগীয় শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ১১ টি বিভাগীয় সংগঠন সক্রিয় তৎপরতা চালু রেখেছে। প্রতিষ্ঠার ১৩১ বছরে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম মুরারিচাঁদ কলেজকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের এক অনন্য মাত্রায়। সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনায় মুক্তমঞ্চ প্রয়োজন, এর কোন বিকল্প নেই। মুক্তমঞ্চ স্থাপনের মাধ্যমে যে কোন অনুষ্ঠান পরিচালনায় অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলা সম্ভব।
এমসি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি দিলোয়ার হোসেন রাহি মুক্তমঞ্চের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বলেন, মুক্তমঞ্চ মত প্রকাশের উন্মুক্ত স্থান চার দেয়ালের গন্ডির বাইরে খোলা আকাশের নিচে একটি প্লাটফর্ম রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক চর্চাসহ বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো অনুষ্ঠানগুলো করতে পারবে।
থিয়েটার মুরারিচাঁদ এর সভাপতি রিংকু মালাকার জানান, মুরারিচাঁদ কলেজ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যের সাথে তাল মিলিয়ে বছরব্যাপী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা হতে থাকে যা ক্যাম্পাসের প্রাণসঞ্চারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্দিষ্ট মুক্তমঞ্চ। কলেজের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তাঁরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। মুক্তমঞ্চ থাকলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের গতি আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করি। বিগতকয়েক বছর থেকে আমরা মুক্তমঞ্চের পক্ষে দাবি নিয়ে এসেছি, আওয়াজ দিয়েছি, মুক্তমঞ্চ আমাদের প্রাণের দাবি।
এস এইচ টি/