সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা গ্রামের দরিদ্র রশিদ আলীর স্ত্রী মুন্নি বেগম বছরখানেক ধরে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ঘটনার পর থানায় হত্যা মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। বর্তমানে মামলার তদন্তকার্যক্রম পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সিলেট অঞ্চলের কাছে রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর হতে চললেও জড়িত আসামিদের একজনও গ্রেপ্তার হয়নি। ঘটনার পর আসামিরা পালিয়ে থাকলেও সম্প্রতি তারা নিজেদের বাড়িঘরে ফিরেছে। আর এ কারণে মুন্নি বেগম দুই অবুঝ কন্যাসন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
মুন্নি বেগম স্বামীর মৃত্যুঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের জন্য বিভিন্নমহলে ধরনা দিয়েও নিরূপায় হয়ে আছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ এবং বিশেষভাবে তিনি তার এলাকার সংসদ সদস্য, সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বিধবা মুন্নি বেগম সোমবার দৈনিক জৈন্তাবার্তার সাথে আলাপকালে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তিনি আক্ষেপের সুরে জানান, ‘ঘটনার পর থেকেই আমি থানায় মামলা করতে পারিনি। পুলিশের ন্যুনতম সহযোগিতা পাইনি। বিশ্বনাথ থানা অভিযোগ গ্রহণ করলেও নানা অজুহাতে মামলা রেকর্ড করেনি। তাই স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ২২ দিন পর আদালতের শরনাপন্ন হয়েছি। আদালতে গিয়েও বিভিন্নরকম আইনি জটিলতার কারণে দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে পড়ে আছি।
বর্তমানে আসামিরা নিজেদের ঘর-বাড়িতে ফিরে আসায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন উল্লেখ করে মুন্নি বেগম বলেন, আসামিরা ঘটনার সময় থেকে পালিয়ে ছিল। সম্প্রতি তারা নিজেদের বাড়িঘরে ফিরেছে। এতে এখন আমি, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ও দুই শিশুকন্যা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। তারা যেকোনোসময় ক্ষোভের বশবর্তি হয়ে আমাদের উপরও হামলা করতে পারে। আমাদের জানমালের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এছাড়া শোনা যাচ্ছে আসামিগণ ঘটনা সাজিয়ে মামলা দায়ের করে আমাদের হয়রানি করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।
এর আগে রশিদ আলীর হত্যাকাণ্ডের পর থানায় মামলা দায়ের করতে না পেরে মুন্নি বেগম ২৩ দিনের মাথায় ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত ৩-এ মামলা (বিশ্বনাথ সিআর নং-৩৩৯/২৩) দায়ের করেন। মামলায় মুন্নি বেগম আসামি করেছেন রামপাশা গ্রামের সাদিক আলীর ছেলে জয়রাজ (২৪), মৃত ফারুক উল্লাহের ছেলে সাদিক আলী (৫৫), সাদিক আলীর স্ত্রী লিলা বেগমসহ (৪৮) অজ্ঞাতনামা ২/১ জনকে। তিনি দাবি করেছেন আসামিরা তার স্বামীকে বেধড়ক পিটিয়ে এবং বিদ্যুতের তারের শক দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
মুন্নি বেগম দাবি করেন, ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট রাত পৌণে ৯টায় বাড়ির উঠানে তার স্বামীর চাচা সাদিক আলী, চাচী লিলা বেগম ও চাচাতো ভাই জয়রাজ গাছের পেয়ারা পাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটান। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক জয়রাজ রশিদ আলীকে ঘর থেকে ডেকে বের করে উঠানে নিয়ে যান। জয়রাজের হাতে থাকা ধারালো ছুরি ও কাঠের রুল দিয়ে নির্দয়ভাবে রশিদ আলীকে মারধর করেন। একপর্যায়ে জয়রাজ রশিদ আলীর পেটে পরপর দু’টি লাথি মারেন। ছুরি দিয়ে রশিদ আলীর পিঠে পরপর দু’টি আঘাত করে রক্তাক্ত জখম করেন। সাদিক আলী কাঠের রুল দিয়ে রশিদ আলীকে আঘাত করতে চাইলে রশিদ প্রতিহতের চেষ্টা করেন। সাদিক আলীর আঘাতে রশিদ আলীর বামহাতের মধ্যমা আঙ্গুলে লেগে জখম হয়। তখন লিলা বেগমও তার হাতে থাকা কাঠের রুল দিয়ে রশিদ আলীকে পিটিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে জখম করে। নির্মমভাবে মারপিটের কারণে রশিদ আলী রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্বামীকে মুমুর্ষ অবস্থায় আবেদনে উল্লেখিত স্বাক্ষীগণের সহায়তায় কাদিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মুন্নি। কর্তব্যরত চিকিৎসক তখন তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মুন্নি বেগম বিষয়টি বিশ্বনাথ থানাকে জানালে এসআই গাজী মোয়াজ্জেম হোসেন বিশ্বনাথ থানার সাধারণ ডায়রি (নং-৬৬৭) মূলে রশিদ আলীর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করে ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেলে পাঠান। সুরতহাল প্রতিবেদনেও রশিদ আলীর শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে রশিদ আলীর মরদেহ মুন্নি বেগমের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। মরদেহ দাফন শেষে ১৭ আগস্ট বিশ্বনাথ থানায় গেলে বিশ্বনাথ পুলিশ নিয়মিত মামলা রেকর্ড করেনি। তাই মুন্নি বেগম কোনো সমাধান না পেয়ে আদালতে মামলা করেন।
বিশ্বনাথ থানা পুলিশসূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পর ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বনাথ থানা পুলিশের এসআই গাজী মোয়াজ্জেম হোসেন চট্টগ্রামে অবস্থিত সিআইডির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষকের কাছে ভিসেরা প্রেরণ প্রসঙ্গে আবেদন করেন। আবেদনে বিশ্বনাথ থানার জিডিমূলে (নং-৬৬৭) তিনি উল্লেখ করেন, রশিদ আলীর (৩৮) মৃত্যুর পর নিহতের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য মরদেহ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে পাঠানো হয়। পরে ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট ওসমানী হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। হাসপাতাল থেকে মরদেহের ভিসেরা নমুনা আলামত চট্টগ্রাম সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর জন্য বিশ্বনাথ থানায় প্রেরণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে ভিসেরা নমুনা চট্টগ্রামের পাঠানো হয়।
মুন্নি বেগম আদালতে মামলা দায়েরের পর আদালতের মাধ্যমে তার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টির তদন্তের অগ্রগতি জানতে চান। এর বিপরীতে ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বনাথ থানা পুলিশ থেকে লিখিতভাবে আদালতে জানানো হয়। তবে ওই প্রতিবেদনে বিশ্বনাথ থানা পুলিশের দাবি রশিদ আলীর মৃত্যুর ঘটনার পর থানায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি। এই দাবিকে অগ্রাহ্য করেছেন রশিদ আলীর স্ত্রী মুন্নি বেগম। তিনি বলেছেন, আমি ১৭ আগস্ট মামলা দায়ের করতে গেলে বিশ্বনাথ পুলিশ মামলা রেকর্ড করেনি। এরপর আমি বেশ কয়েকবার ঘুরাঘুরি করে কোনো উপায় না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।
এলএইচ