জৈন্তাপুরে বালু উত্তোলনের ফলে ঝুঁকিতে পাউবো'র বাঁধ
শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:০০

জৈন্তাপুরে বালু উত্তোলনের ফলে ঝুঁকিতে পাউবো'র বাঁধ

সাইফুল ইসলাম বাবু, জৈন্তাপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩/০৯/২০২৪ ০১:০৩:৫৮

জৈন্তাপুরে বালু উত্তোলনের ফলে ঝুঁকিতে পাউবো'র বাঁধ

ছবি নিজস্ব


সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় বড়গাঙ নদীতে ইজারাকৃত সীমানার বাইরে ও বাঁধ সংলগ্ন ১৮০ ফুট ভেতরের স্থান থেকে বালু উত্তোলনের ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা বাঁধের তিন কিলোমিটার অংশ। এতে করে চরম শঙ্কায় দিন কাটছে বাঁধের ভেতরে স্থায়ীভাবে বসবাসরত কয়েক হাজার বাসিন্দার। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিজপাট ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রামের তিন কিলোমিটার অংশজুড়ে বালু উত্তোলনের ফলে বড় একটি অংশ ইতোমধ্যে ধসে পড়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৭ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সারী গোয়াইন বাঁধ প্রকল্পের নামে বড়গাঙ ও সারী নদী সংলগ্ন ১৭ কিলোমিটার অংশজুড়ে বিশাল বাধ নির্মাণ করা হয়। ১নং নিজপাট ইউনিয়ন ও ২নং জৈন্তাপুর ইউনিয়নে মোট ৭টি ওয়ার্ডের মানুষের বসতভিটা ও আবাদি জমি পাহাড়ি ঢল থেকে সৃষ্ট বন্যায় নিরাপদ রাখার জন্য এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ফেরিঘাট ব্রিজের ২০০ মিটার পূর্বে বিশাল এক অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। যার ফলে বাঁধের ভেতরে বসবাসকারী মানুষের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি শত শত গবাদিপশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

পরবর্তীতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এই অংশটি সংস্কারে ১৯৯০ সালে পূর্ব লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রামের এক কিলোমিটার অংশজুড়ে মাটির সাথে বড় বড় ঢাক ও বোল্ডার পাথর দিয়ে শক্ত ও মজবুতভাবে বাঁধ পুনঃনির্মাণ করা হয়।

বাঁধের ঠিক বিপরীত দিকে বড়গাঙ এলাকায় খাস ভূমি থেকে বালু উত্তোলন ও বিক্রির অনুমতি থাকলেও বাঁধের নিরাপত্তার স্বার্থে ১৮০ ফুট পর্যন্ত বালু উত্তোলনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে বিগত ৮/১০ বছর ধরে বড়গাঙ বালু ব্যবসায়ীদের একটি কুচক্রী মহল অতিরিক্ত মুনাফার লোভে পূর্ব লক্ষ্মীপ্রসাদ এলাকায় বাঁধ সংলগ্ন স্থানে ১৮০ ফুটের ভেতর থেকে বালু সংগ্রহ শুরু করে। নদীর নিচের অংশ থেকে বালু কাটার ফলে বোল্ডার পাথরগুলো ধসে পড়তে শুরু করে এবং শ্রমিকেরা রাতের আঁধারে বাঁধের সেই পাথরগুলো গোপনে নৌকাযোগে চুরি করে নিয়ে যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হাসনাত বলেন, বড়গাঙ এলাকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় বাঁধের ১৮০ ফুটের ভেতর থেকে বালু ও পাথর চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পূর্ব লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রাম সংলগ্ন বাঁধের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকার বড় অংশ ভেঙে গেছে। প্রতিবছর সারী গোয়াইন নদীতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের ফলে ভাঙনের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে চরম শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে বাঁধ এলাকার কয়েক হাজার পরিবার।

পূর্ব লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ইসমাইল আলী বলেন, দুই বছর আগে গ্রামের লোকজন বাধ্য হয়ে তাদের নৌকা আটক করে ডুবিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে কিছু কুচক্রী মহল নানাভাবে হুমকি প্রদান করে আসছে।

তিনি বলেন, এভাবে বালু উত্তোলন ও পাথর চুরি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে বাঁধের এই অংশ যেকোনো সময় ভেঙে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

স্থানীয় অপর প্রবীণ ব্যক্তি আবদুল লতিব বলেন, ২০১৭/১৮ সালে বাঁধ রক্ষার প্রতিকার চেয়ে উপজেলা প্রশাসন ও পরিষদের নিকট লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করেন এলাকাবাসী। সে সময় জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌরিন করিম সরেজমিনে বাঁধের দূরবস্থা দেখে ১৮০ ফুট পর্যন্ত নদীর অংশে লাল নিশানা টাঙিয়ে দেন এবং নিশানার ভেতরের অংশ থেকে সব ধরনের বালু উত্তোলন ও পাথর চুরির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু কয়েক মাস বালু উত্তোলন বন্ধ থাকলেও পুনরায় রাতের আঁধারে সক্রিয় হয়ে ওঠে চক্রটি।

এ বিষয়ে স্থানীয় সালিশ ব্যক্তিত্ব আবদুল হান্নান চৌধুরী বলেন, বহুবার এলাকার কিছু ব্যবসায়ীকে বারবার নিষেধ দেওয়ার পরও তারা কর্ণপাত করেনি।

তিনি এই চক্রের সাথে জড়িত স্থানীয় ব্যবসায়ী জমির মোল্লা আমিন, শেখর বাবু, রফিক, রুহুল ও আনাইছসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেন জানান, এ বিষয়ে স্থায়ী প্রতিকার চেয়ে পূর্ব লক্ষ্মীপ্রাসাদ গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের সাধারণ মানুষদের স্বাক্ষর নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।

তিনি বলেন, কয়েকমাস পূর্বে ইসমাইল আলী নামক এক ব্যক্তিকে বড়গাঙ বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়। তখন থেকে বাঁধ সংলগ্ন স্থান হতে বালু উত্তোলনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে চক্রটি। গত ২১ সেপ্টেম্বর পূর্ব লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রামে বাঁধ এলাকা থেকে বারকি শ্রমিকরা বালু উত্তোলনে গেলে গ্রামবাসীর সাথে তারা বাকবিতণ্ডায়  জড়ায়। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ বিবাদে জড়ানোর উপক্রম হলে স্থানীয় মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে উভয়পক্ষকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে সে স্থানে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

এ বিষয় বড়গাঙ বালুমহালের ইজারাদার ইসমাইল মিয়া বলেন, বাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে বালু উত্তোলনে কোনো সম্পৃক্ততা বা নির্দেশনা ইজারাদার কর্তৃপক্ষের নেই। এতে কেউ জড়িত থাকলে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। 

জৈন্তাপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রিয়াজ পারভেজের সাথে মুঠোফোনে আলাপকালে জানান তিনি ছুটিতে আছেন। এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ তার কার্যালয়ে এলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে নিশ্চিত করেন।

এদিকে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া জানিয়েছেন, পূর্ব লক্ষ্মীপ্রাসাদ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে তার দপ্তরে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। উক্ত বিষয়ে উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদারকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

জৈন্তা বার্তা / আরআর