সুনামগঞ্জের ষোলঘরে মেলায় ডুবছে খেলা
শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৬:০২

সুনামগঞ্জের ষোলঘরে মেলায় ডুবছে খেলা

মনোয়ার চৌধুরী, সুনামগঞ্জ

প্রকাশিত: ২২/০১/২০২৫ ১০:১৪:০৪

সুনামগঞ্জের ষোলঘরে মেলায় ডুবছে খেলা

ছবি: নিজস্ব


সুনামগঞ্জে ষোলঘর ক্রীড়া সংস্থার স্টেডিয়ামে একসময় ফুটবল-ক্রিকেটসহ নানা ধরনের খেলাধুলা করতেন নানা বয়সী শত শত খেলোয়াড়। স্টেডিয়ামটি পৌর শহরসহ আশপাশের এলাকার কাছে ‘ষোলঘর খেলার মাঠ’ নামে পরিচিত ছিল। বছরজুড়ে এ মাঠে আয়োজন করা হতো নানা প্রতিযোগিতা। এই মাঠে জন্ম হয়েছে বড় মাপের শত খেলোয়াড়ের। তবে সময়ের বিবর্তনে আজ সেই মাঠ থেকে খেলোয়াড় উঠে আসায় ধস নেমেছে। এর জন্য স্থানীয় খেলোয়াড়রা দায়ী করছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও প্রশাসনকে। 

স্থানীয় খেলোয়াড়দের অভিযোগ, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ষোলঘর স্টেডিয়ামে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার মেলা হয়েছে। মেলার পরে আর যথাসময়ের মধ্যে মাঠ খেলার জন্য প্রস্তুত করা হয়নি। মেলার পর মাঠ স্থানীয়দের চেষ্টায় খেলাধুলার জন্য উপযোগী হতে সময় লাগত বছরখানেকের বেশি। এছাড়া মেলা শুরু হওয়া থেকে শেষ পর্যন্ত দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত মাঠটি থাকত মেলার দখলে। ফলে খেলাধুলার জায়গা না পেয়ে ধীরে ধীরে এই মাঠের খেলোয়াড়রা ঝরে পড়েছেন। কিন্তু কখনোই জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও প্রশাসন খেলোয়াড়দের কথা চিন্তা করেনি। বার বার বাধার মুখেও এই খেলার মাঠে মেলার নামে খেলোয়াড় ধ্বংসের আয়োজন হয়েছে। 

সবকিছুর পর স্থানীয় খেলোয়াড়রা বার বার নিজেদের চেষ্টায় মাঠকে খেলার জন্য প্রস্তুত করেছেন। এবারও খেলাধুলায় এই ব্যস্ত সময়ে মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার আয়োজনের কথা শুনে ক্ষুব্ধ তারা। খেলার মাঠে মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলা বন্ধের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করছেন খেলোয়াড়, স্থানীয় বাসিন্দা, আইনজীবী ও বিভিন্ন মসজিদের মুসল্লিগণসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে খেলার মাঠে মেলা বন্ধের দাবি জানিয়ে এলেও অদৃশ্য শক্তির প্রশ্রয়ে মেলা আয়োজনে মাঠ প্রস্তুত করছে বাস্তবায়নে থাকা ‘বাংলাদেশ মুসলিন বেনারসি অ্যান্ড জামদানি সোসাইটি’ নামের প্রতিষ্ঠান। এলাকাবাসী ও খেলোয়াড়দের দাবিকে উপেক্ষা করে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন মেলার অনুমোদনসহ সার্বিক সহযোগিতা করছে। আর ব্যাপারটি জেনে স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। 

জানা যায়, গত ২০ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে ‘ষোলঘর খেলার মাঠে’ মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার জন্য খুঁটি পোতা হয়। সে সময় সাথে সাথে স্থানীয় যুবকরা ফেসবুকে প্রতিবাদ ও অন্য স্থানে মেলা করার আহŸান জানান। পরের দিন ২১ ডিসেম্বর বিকেলে ‘খেলার মাঠে মেলা নয়’ এমন দাবিতে বৃহত্তর ষোলঘরবাসী মতবিনিময় সভা করেন। এর পরের দিন ২২ ডিসেম্বর ষোলঘর স্টেডিয়ামে মানববন্ধন করেন খেলাপ্রেমী স্থানীয় জনতা। তার পরদিন ২২ ডিসেম্বর মাঠ খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া ও মেলার অনুমতি না দিতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! স্মারকলিপি প্রদানের পরদিনই স্বয়ং সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় সুনামগঞ্জ শিল্প-পণ্য বাণিজ্য মেলার ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হয়। যৌক্তিক দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে খেলার মাঠে মেলা বন্ধ না করে উল্টো আয়োজনের প্রস্তুতি গ্রহণ করায় শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। এ অবস্থায় অবিলম্বে ষোলঘর আবাসিক এলাকায় খেলার মাঠে মেলার অনুমতি বাতিলের দাবিতে ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ের সম্মুখে মানববন্ধন করেন আইনজীবীরা। এর পরদিন ২৭ ডিসেম্বর বাদ জুমা ষোলঘর স্টেডিয়াম এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন বিভিন্ন মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হওয়া তৌহিদী জনতা। এছাড়া মেলা বন্ধের দাবিতে ব্যবসায়ীরা শহরজুড়ে মাইকিং করতে শোনা যায়। এরপর ১২ জানুয়ারি পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও শিক্ষকরা মেলা বন্ধের দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেন। 

ষোলঘর মাঠের খেলোয়াড় মনোয়ার রফি আফিন্দী বলেন, ষোলঘর মাঠে খেলাধুলা করে হাজার হাজার মানুষ বেড়ে উঠেছেন। এর মধ্যে অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে খেলেছেন। অনেকে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে খেলেছেন। এই মাঠ শুধুমাত্র যে খেলাধুলা করার জন্য ব্যাপারটা এমন না। এখানে সুস্থ বিনোদন চর্চার জন্য, শরীরচর্চার জন্য লোকজন আসেন। কিন্তু এই মাঠকে ঘিরে প্রতিবছর শীতকাল এলে যে অপতৎপরতা চলে সেটা খুবই দুঃখজনক। মাঠ যদি কোনোদিন কথা বলতে পারতো, তাহলে মাঠ নিজেও কষ্ট থেকে বলতো যে আমাকে মুক্তি দিন। আমাকে এভাবে খুঁড়ে, আমার বুকে কংক্রিট দিয়ে স্থাপনা তৈরি করে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করে মেলা আয়োজন আপনাদের ঠিক হচ্ছে না। 

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিবছর মাঠে টুর্নামেন্টের আয়োজন করি। মেলাটা হয়তো চলে যাবে, হয়তো আবার মাঠ খেলার জন্য প্রস্তুত করবো। কিন্তু তখন অনেকেই খেলতে আগ্রহী হবে না। কারণ মাঠের মধ্যে পেরেক, ভাঙা কাঁচের টুকরো, বালি, রড ইত্যাদি জিনিস থাকে। যেগুলো অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হয়। ফলে এসবের ভয়ে খেলোয়াড়রা মাঠে আর খেলতে চায় না। খেলোয়াড়রা যদি এসবের ভয়ে মাঠে আসে না, তাহলে নতুন প্রজন্মের কী হবে?

ষোলঘর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মুশারফ হোসেন বলেন, ষোলঘর খেলার মাঠের পাশে চারটি মসজিদ আছে, মসজিদের পাশে ৩ থেকে ৪টি মাদ্রাসা রয়েছে। এটি একটি আবাসিক এলাকা। এই এলাকার মধ্যখানে এটিই একমাত্র খেলার মাঠ, যে মাঠে অসংখ্য শিশু-কিশোর খেলাধুলা করে। এই মাঠে খেলা বন্ধ করে মেলা দেওয়া আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। 

তিনি আরও বলেন, সমাজের সব ধরনের মানুষ এই মাঠে মেলা বন্ধের জন্য অবস্থান নিয়েছেন। তারপরও প্রশাসন এখানে মেলা চালিয়ে নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে এইরকম একটা বাণিজ্য মেলা হচ্ছে, যেখানে হবে বেহায়াপনা, অশ্লীলতাসহ অসামাজিক কার্যকলাপ। এই মেলার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। এলাকার গরিব মানুষ আরও গরিব হয়ে যাবে। এই মেলার কারণে অপকর্ম বেড়ে যাবে। আমরা চাই এই মেলা বন্ধ হোক। 

মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার মামুন বলেন, আমরা এ বছর ষোলঘর, মোহাম্মদপুর, নবিনগর, বিলপাড়বাসীসহ সবাই মিলে একটি আন্দোলন শুরু করেছি- খেলার মাঠে মেলা নয়। কিন্তু এতগুলো মানুষের দাবিকে তোয়াক্কা না করে বর্তমান প্রশাসক ও প্রশাসনে যারা আছেন, তারা মেলার অনুমোদন দিয়েছেন। যার কারণে আমরা ক্ষুব্ধ। আমরা আশা করবো এখনও যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থা থেকে ফিরে এসে মেলা বন্ধ করুন। খেলার মাঠে খেলাই হোক। আমাদের আবাসিক এলাকার যে একটি পরিবেশ সেটি ঠিক রাখুন। 

তিনি আরও বলেন, ষোলঘর মাঠে মেলা বন্ধ করে শহরের পশ্চিম দিকে অনেক খালি জায়গা পড়ে আছে, সেখানে মেলা করা যেতে পারে। কারো কোনো সমস্যা হবে না। 

এসময় সুনামগঞ্জের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ষোলঘর খেলার মাঠে মেলা বন্ধ করে আমাদের প্রতি ভালোবাসার সুদৃষ্টি দিন। 

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে বাঁচিয়ে রাখা লাগবে, দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা লাগবে। এ পর্যায়ে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং জেলার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য এর সাথে জড়িত মানুষের আয়ের একটা পথ করে দেওয়ার জন্য এই মেলা আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় শব্দদূষণ ঘটলে মেলা বাতিল করে দেবো। 

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেন, যদি কোনো খেলার মাঠে বা কিশোর-যুবকদের বিনোদনের স্থানে প্রশাসন কর্তৃক মেলার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে মেলা শেষে মাঠকে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। এটার তাদের দায়িত্ব এবং এটা করতে হবে। 

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে এক মাসব্যাপী এই মেলা শুরুর কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মেলা উদ্বোধন হয়নি। এতে প্রায় এক মাস ধরে মেলার নামে খেলার মাঠ দখলে রয়েছে। মেলা শুরু হলে আরও দুই থেকে তিন মাস মাঠটি মেলার দখলে থাকবে। এর ফলে ধীরে ধীরে খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন খেলোয়াড়রা। 

সচেতন মহল মনে করেন, শিশু-কিশোর-তরুণদের নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকা খুবই জরুরি। খেলাধুলা শুধু বড় বড় ক্লাবে কিংবা জাতীয় দলে স্থান পাওয়া কিংবা প্রতিযোগিতায় নেমে পদক পাওয়ার জন্য নয়। বরং দেহ-মনের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের জন্য শিশু-কিশোর-তরুণদের তাতে অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সরকার থেকে যদি খেলাধুলার জন্য মাঠের সুযোগ-সুবিধা করে না দেওয়া হয় তাহলে শিশু থেকে শুরু করে কিশোর-তরুণ ও তরুণীদের মোবাইলে আসক্ত হওয়া, বাজে নেশা, রোগবালাই থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব দেখা যায়, তার পেছনে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সচেতন মহল।

জৈন্তাবার্তা / সুলতানা