
ছবি: নিজস্ব
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা হুমায়ুন রশিদ চত্বর থেকে চন্ডিপুল এলাকায় ট্রাক দুর্ঘটনায় গেলো ১ বছরে প্রাণ ঝড়েছে ১০ জনের। সড়কে ট্রাক পার্কিং করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। অথচ নগরীতে সড়কে ট্রাক পার্কিং না করার জন্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করে টার্মিনাল নির্মাণ করে দিয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু চালকরা টার্মিনালে ট্রাক না রেখে পুরো নগরীকেই স্ট্যান্ড বানিয়ে ফেলেছে। এর ফলে ঘনঘন দুর্ঘটনা ঘটছে। ট্রাক টার্মিনালকে সচল করে দুর্ঘটনা রোধ করা নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষ কিংবা নগর পুলিশ কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তারা ব্যস্ত একে অপরকে দোষারোপ করা নিয়ে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমা হুমায়ুন রশিদ চত্বর থেকে চন্ডিপুল পর্যন্ত মাত্র ২ কিলোমিটার সড়ক এখন কার্যত ট্রাক টার্মিনাল। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে শত শত ট্রাক পার্ক করে রাখা হয়, যার কারণে শহরে প্রবেশ ও বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ট্রাক চালকরা টার্মিনাল ব্যবহার না করে সড়কেই পার্কিং করছে পণ্যবাহী ট্রাক। এর ফলে বাড়ছে যানজট, ঘটছে দুর্ঘটনা, আর সৃষ্টি হয়েছে অনিয়মের বিশৃঙ্খল চিত্র। সংশ্লিষ্টদের হিসেব মতে পাথর, বালু এবং কাঁচামাল পরিবহনের জন্য সিলেটে প্রতিদিন শতশত ট্রাক যাতায়াত করছে। এর বাইরেও আমদানি রফতানিকৃত অন্যান্য পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়েজিত শতশত ট্রাক প্রতিদিন শহরে ঢুকছে। সব মিলিয়ে সিলেটে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজারের বেশি ট্রাক যাতায়াত করে।
সিলেট হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, গেল এক বছরে শুধু ট্রাক পার্কিং করতে গিয়ে দক্ষিণ সুরমার এই দুই কিলোমিটার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ জন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
চন্ডিপুল এলাকার ব্যবসায়ী মো. আজাদুর রহমান জানান, ট্রাক টার্মিনাল থাকা সত্বেও সড়ক ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ট্রাক পার্কিং করা হচ্ছে। এতে ট্রাক মালিক ও চালকদের সঙ্গে অনেক সময় হাতাহাতি নিয়মিত ঘটনা। একই অভিযোগ মুদি দোকনি কালাম মিয়ার। তিনি বলেন, ট্রাক টার্মিনালে ট্রাক না রেখে সড়কের উপর পার্ক করা হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এসব বিষয়ে বারবার বলার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শতশত পণ্যবাহী ট্রাক সিলেট নগরীতে প্রবেশের জন্য এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত ৯টার পর একে একে শহওে প্রবেশ করে পণ্যবাহী এসব ট্রাক। ট্রাকপতি ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন নজির আহমদ স্বপন নামের এক ব্যাক্তি।
একই সূত্রমতে, স্বপনের ২৪টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। তিনি ট্রান্সপোর্ট মালিক গ্রæপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। ওই এলকায় রয়েছে তার বিশাল সিন্ডিকেট। চাঁদা উত্তোলনের জন্য রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ট্রাকের চালক ও হেলপারকে মারধর করে তার লোকজন।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, স্বপনের এই সিন্ডিকেটে মালিক-শ্রমিক ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের লোকজনও জড়িত আছেন। মাস শেষে এই চাঁদার ভাগ যায় সবার পকেটে। স্বপন বাহিনীকে চাঁদা না দিলে পণ্যবাহী কোনো ট্রাক শহরে প্রবেশই করতে পারে না। নাম পরিচয় প্রকাশ না করে বেশ ক’জন ট্রাকচালক ও হেলপার জানান, ইমন ও জামান নামে দুই লাইনম্যান ট্রাক থেকে চাঁদা কালেকশন করেন। তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নজির আহমদ স্বপন। তিনি জৈন্তা বার্তা জানান, চাঁদা আদায় কে করছে জানি না। চালকেরা ওই এলাকায় গাড়িপার্ক করে রাখেন, যেকারণে খুশি হয়ে তারা কিছু টাকা দেন। এখানে জোরপূর্বক তো কিছু হচ্ছেনা।
২০১৯ সালে দক্ষিণ সুরমার পারাইরচক এলাকায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় সিলেট কেন্দ্রীয় ট্রাকটার্মিনাল। তবে অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে টার্মিনাল। নানা অজুহাতে টার্মিনালে ট্রাক রাখতে চান না চালকেরা। টার্মিনালে ট্রাক ফেরাতে ব্যর্থ পুলিশ প্রশাসনও। অবশ্য মালিক ও শ্রমিক নেতাদের দাবি সুযোগ-সুবিধানা থাকার কারণে টার্মিনালে ট্রাক রাখা যাচ্ছেনা।
বর্তমানে দক্ষিণ সুরমার তেলিবাজার পয়েন্ট, পাররাইচকস্থ সিলেট জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের অফিসের সামনে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অন্তত এক হাজারের বেশি মালবাহী ট্রাক পার্কিং করা থাকে। ট্রাক টার্মিনালের বাইওে বিভিন্ন এলাকায় যত্রতত্র ট্রাক পার্কিংয়ের ফলে শহরে প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন পথচারীসহ সাধারণ নাগরিক। এতে প্রায় সময় সিলেটের প্রবেশদ্বার চন্ডিপুল ও হুমায়ুন রশীদ চত্ত¡র সড়কটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
এদিকে ট্রাক শ্রমিক ও মালিক পক্ষের দাবি, ভ‚ল যায়গায় ট্রাক টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যে কোনো স্থানে যদি এটি র্নিমাণ করা হতো তাহলে দুরত্বের অজুহাত কেউ দেখাতে পারতোনা। তাছাড়া টার্মিনালে ভেতরে খাবারের হোটেল, ওয়ার্কশপ, মসজিদসহ কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। যেকারণে ট্রাক চালকরা টার্মিনালে ট্রাক রাখতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা ট্রান্সপোর্ট মালিক গ্রæপের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) নজির আহমদ স্বপন বলেন, এখানে কোনো চাঁদা নেয়া হচ্ছেনা। সড়কের পাশেগাড়িগুলো শৃঙ্খলা করাতে লোকতো লাগে। সেজন্য টোল বাবদ গাড়িপ্রতি ১৫০ টাকা কওে আগে নেওয়া হতো। চালকেরা স্বেচ্ছায় এই টাকা দিতেনে। এর বাইরে কিছু নয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টার্মিনাল চালুর বিষয়ে সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের সহযোগীতা করা হচ্ছেনা। তাছাড়া টার্মিনালের ভেতরে খবারের হোটেল, ওয়ার্কশপ নেই যেকারণে চলকেরা আগ্রহ হারাচ্ছে।
সিলেট জেলা ট্রাক পিকআপ কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জিলু মিয়া বলেন, আগে ১৫০ টাকা করে টোল আদায় করা হতো। ইদানিং তো আমার ড্রাইভাররা আমাকে কিছু বলেনি। খোঁজ নিয়ে দেখব।
ট্রাক টার্মিনাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একদিকে মহাসড়ক থেকে টার্মিনালের দুরত্ব অনেক বেশী। অন্যদিকে টার্মিনালের ভেতরে খবারের হোটেলসহ কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। যে কারণে চালকেরা টার্মিনালে আসতে চাচ্ছেনা। একাধিকবার সিটি করপোরেশনকে বিষয়টি জানিয়েছি। টার্মিনালটি পুরোদমে চালু করে দিতে বলেছি। এখন সিটি করপোরেশনের উচিৎ আমাদেরকে সহযোগিতা করা।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, সম্প্রতি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের মালিক ও শ্রমিক পক্ষের নেতারা বেশকিছু দাবি নিয়ে আসছিলেন। তারা তাদের বক্তব্য দিয়ে গেছেন। ট্রাক টার্মিনাল চালু হোক সেটি সিটি কর্পোরেশনও চায়। আর তারা যে সকল সুযোগ-সুবিধা চালুর কথা বলছেন সেগুলো চালু করতে গেলে তো আর্থিক একটা ব্যাপার আছে। যত দ্রæত সম্ভব টার্মিনাল পুরোদমে চালু করা যায় সে বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নেয়া হবে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, সিলেটে নগরীতে প্রবেশের অপেক্ষয় সবকটি প্রবেশমুখে প্রতিদিনই শতশত ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলোতো টার্মিনালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ তারা মালামাল নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এয়াড়া সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নগরীতে ট্রাক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেজন্য ট্রাকগুলো প্রবেশমুখে এসময়টাতে দাঁড়িয়ে থাকে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ট্রাক টার্মিনাল চালুর বিষয়ে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আমরা উভয় পক্ষের সাথে একাধিকবার বসেছি কিন্তু তাদের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয়নি। মলিক ও শ্রমিক পক্ষ চাইলে ট্রাক টার্মিনাল পুরোদমে সচল করা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে দুর্ঘটনা রোধে পুলিশ প্রশাসন কার্যকর
তারা বলেন, যে উদ্দেশ্যে কোটি টাকায় ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ, সেটি আজ ব্যবহারবিহীন। তার বদলে শহরের প্রধান সড়কগুলোই হয়ে উঠেছে ট্রাক স্ট্যান্ড। একদিকে প্রশাসনের দায়সারা মনোভাব, অন্যদিকে মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের প্রভাব-সব মিলিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই নগরবাসীর।
জৈন্তাবার্তা / রহমান
