ওয়াজ-মাহফিল সংস্কৃতি
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৩২

ওয়াজ-মাহফিল সংস্কৃতি

অতিথি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৪/১১/২০২৩ ১০:১০:১২

ওয়াজ-মাহফিল সংস্কৃতি


ওয়াজ অর্থ উপদেশ, নসিহত, বক্তব্য। যিনি ওয়াজ করেন তাকে ওয়ায়েজ বা বক্তা বলে। ওয়াজ-নসিহত বা উপদেশ মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এটি মানব সমাজের উন্নতি ও সংশোধনের অতুলনীয় পন্থা। 

ইসলামের শুরু থেকেই এর পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে। এখন শীতের মৌসুম। শীতের হিমেল হাওয়া আমাদের দেশে ওয়াজের বার্তা নিয়ে আসে। শীত ছাড়া যেন মাহফিল জমে না। বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে ওয়াজ-মাহফিল। 

শীতকালে আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জে এমনকি শহরে ওয়াজ মাহফিলের ধুম পড়ে যায়। শীতের রাতে পাড়া-মহল্লায়, গ্রাম-গঞ্জে খেটেখাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ এবং উচ্চ শিক্ষিতরাও ওয়াজ-মাহফিলে অংশগ্রহণ করে থাকেন। শীতকালে রাত্রিবেলার ওয়াজ-মাহফিল এক পরিচিত চিত্র। শীতকালে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ওয়াজ-মাহফিল উপলক্ষে এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করে। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ওয়াজ-মাহফিলের জন্য বছরজুড়ে অধীর অপেক্ষায় থাকে। 

ওয়াজ-মাহফিলের  বক্তারা আবেগঘন সুরে মননশীল বাচনভঙ্গিতে বক্তৃতা দিয়ে মুসলমানদের হৃদয়কে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে ইসলামি সঙ্গীতায়োজনে এখন  নতুনত্ব ও সৃজনশীলতার মাত্রা যোগ হয়েছে। যা ওয়াজ-মাহফিলগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। শীতকালীন ওয়াজ-মাহফিলের এ সংস্কৃতি আমাদের শীতকালকে বিচিত্রময়তা দান করে। ওয়াজ-মাহফিলে আপামর জনসাধারণের জন্য চারার শেকড়ে পানি ঢালার মতো। যারা জানে না মাতাপিতার খেদমত করতে হয়, মাতাপিতার মুখ থেকে যেনো 'উফ' শব্দ বের না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। তারা এইসব সমাবেশের মাধ্যমে মাতাপিতার অধিকার সম্বন্ধে জানতে পারে। মাতাপিতার পদতলে নিজেকে সঁপে দিতে পারে। 

ওয়াজে গিয়ে সামান্য হলে ও নসীহা নিয়ে আসুন। নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করুন, নিজে নিজের আমল পরিবর্তন করুন। অন্যকে অনুপ্রাণিত করুন এবং ধর্মের দিকে আগানু অর্থ ধর্মীয় জ্ঞান বাড়ানো ও পরহেজগারি করা।ইসলাম কে নিজের জীবনে, সমাজে বাস্তবায়িত করা। নিজেকে সেইভ করা ভয়াবহ জাহান্নাম থেকে। 

ওয়াজ-মাহফিলে তরুণদের উপচে পড়া ভীড় থাকে। একটা মানুষ জীবনভর দাড়ি ছেঁটেই চলছে। সে কোনোদিন ভাবতেও পারে নি যে, দাড়ি রাখা ইসলামের বিধান। ওয়াজে যখন ওয়ায়েজ সাহেব বুঝিয়ে দেন, দাড়ি রাখলে এবং টুপি মাথায় দিলে আল্লাহর রাসূল খুশি হবেন এবং পরকালে তাঁর সাথে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। আর যদি দাড়ি না রাখো, টুপি না পরো, তাহলে জর্জ ডব্লিউ বুশ খুশি হবে এবং পরকালে তোমার স্থান হবে বুশের বাসস্থান চিরস্থায়ী নরকে। তখন অন্তত বুশের বিরোধীতা করার জন্য হলেও একটা যুবক দাড়ি রাখবে, টুপি মাথায় দিবে। 

প্রত্যেকটা স্থানেই ওয়াজ মাইক দিয়ে হয়। ফলে মহিলারাও ওয়াজ শুনতে পায়। এমনও অনেক ওয়ায়েজ আছেন, যাঁদের জনপ্রিয়তা পুরুষ সমাজ ডিঙিয়ে নারী সমাজেও রয়েছে। এইসব হুজুর যখন বিনয়ের সুরে পর্দার আড়ালের মা-বোনকে স্বামীর অধিকার সম্পর্কে অবগত করবেন, বেহায়া-বেলেল্লাপনা ত্যাগ করার আহবান জানাবেন, আল্লাহর কসম, শ'তে একজন হলেও হেদায়াতের পথ খোঁজে পাবে।এরকম নানান বিষয় রয়েছে, যেগুলো একটু জোর দিয়ে বোঝালেই হাজার হাজার তরুণের চোখ খুলবে, দ্বীনের সন্ধান পাবে। কিন্তু বুঝিয়ে বলতে পারা ওয়ায়েজের বড় অভাবে। ওয়েয়েজরা একটু সাবধান হলে, নির্ধারিত আকিদা, নির্দিষ্ট বিষয়াবলির আলোচনা করলে সমাজের চেহারা পাল্টে যেতে বাধ্য। 

এখন এই ওয়াজ-মাহ্ফিল সম্পর্কে আমার কিছু কথা আছে। তা হলো যারা চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে বক্তা ভাড়া করে বক্তাদের মুখ থেকে ধর্মীয় বাণী শুনে থাকে, আমার জানা মতে তাদেরটা ভাল কাজ বা সওয়াব পাওয়ার পর্যায়ে পড়ে। কারন তারা অজানাকে জানার জন্যই এটা করে থাকে। কিন্তু যে বক্তারা নিজেরা টাকার বিনিময়ে ধর্মের বাণী প্রচার করে থাকে, তাদেরটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা আমার অজানা। আমি এ পর্যন্ত যত দেখেছি, কম হোক আর বেশিই হোক, টাকার বিনিময় ছাড়া কোন বক্তাই ওয়াজ-মাহফিল আসেন নি? কিছু বক্তাই এমন আছে যারা টাকা ছাড়া ওয়াজ করেন বা তাদেরকে কমিটির পক্ষ হতে যা দেয়া হয় তারা তা না দেখে পকেটে করে নিয়ে যান)। আবার কেউ কেউ বলেন যে, বক্তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য নাকি এই টাকাগুলো দেওয়া হয়। কিন্তু আমি বলবো এই কাজটা কি বক্তারা সেচ্ছায় করতে পারেন না? 

আমাদের নবীজি তো কোন কিছুর বিনিময়েও কখনো ধর্মের বাণী প্রচার করেন নি? তাহলে বর্তমানে ওয়াজ-মাহফিল নামে এটা কেনই বা করা হচ্ছে? তবে যে কারনেই হোক না কেন, বক্তাদের ধর্মীয় বাণী বিক্রয়ের এই ধরনের প্রক্রিয়াকে আমি মোটেও সমর্থন করতে পারছি না। তা নিয়ে দর-কষাকষি বা বেশি চাহিদা পেশ করা নয়। পণ্য কেনাবেচার মতো দরদাম করে, অগ্রিম বুকিং মানি নেওয়া, বিনিময় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, কম দিলে এ কারণে পরবর্তী বছর দাওয়াত গ্রহণ না করা এবং দুই স্থানের যেখানে টাকা বেশি দেওয়া হয় তা গ্রহণ করা ওলামায়ে কেরামের শান, মান ও ইজ্জতের সঙ্গে মানানসই নয়, এতে দ্বিনের অসম্মান হয়। 

আমি গত কয়েক বছর থেকে গভীর মনযোগে এসব মাহফিল পর্যবেক্ষণ করে অনেক হতাশ হয়েছি। এখন আর কোরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন যাপনের তাগিদ দেওয়া বক্তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় নয়। আলোচ্য বিষয় হল অন্য আলীমদের গীবত করা, যাদের সাথে বক্তার আক্বীদার মিল নেই তাদের তীব্র ভাষায় আক্রমন করা। আলেম আরেক আলেম এর নাম ধরে প্রকাশ্যে নিন্দা জ্ঞাপন করছেন তা আমাদের ধর্ম মতে পাপ! শস্য ভূত থাকলে তা দিয়ে কী ভূত তাড়ানো সম্ভব! তাই বলব ওয়াজ করে টাকা কামাবেন, মানুষের ফায়দা করে, দীনের প্রচার করে কামান। নাহলে শেষ বিচারটা ওপারেই হবে।

আবার শ্রোতা ও বক্তা (সিংহ ভাগ) ওয়াজ বা নসিহত দ্বারা উপকৃত হই না। এজন্য আমরাই দায়ী! সবকিছু লোক দেখানো!! অমুক এলাকা ওয়াজের আয়োজন পাঁচ লাখ ব্যয় করেছে অন্য দল বা গ্রাম দশ লাখ খরচ করবে! এটা নিছক লোক দেখানো। আরো সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, খোদ আয়োজক মহলের অনেক আছেন যা ধর্ম কর্মের প্রতি এতটা যত্নশীল নন! 

লেখক: আবু জাফর শিহাব (এল এল বি)

JA