বাংলাদেশে বসবাসরত ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্যতম একটি জনগোষ্ঠী হচ্ছে মণিপুরি মুসলমান বা পাঙাল জনজাতি। আমরা জাতিগত ভাবে যেমন মণিপুরি, অনুরূপভাবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও মণিপুরি। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলমান হওয়ায় অন্যান্য মণিপুরি জনগোষ্টী থেকে আমাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে ধর্মীয় বিভাজন জনিত সামান্য ভিন্নতা।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক ১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত ৪০তম অধিবেশনে গৃহীত ১০৭ নং কনভেনশনে আদিবাসী ও উপজাতীয় ভাষা বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে কিছু নীতিমালা তৈরি করে। উল্লেখ্য বাংলাদশ এ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী অন্যতম একটি দেশ। উক্ত কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২১-এ উল্লেখ রয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জাতীয় জনসমষ্টির অবশিষ্ট অংশের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সকল স্তরে শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আমাদের গান, ছড়া, কবিতা, উপকথা, রূপকথা ও মিথোলজিগুলো বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবে মণিপুরি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, অবলুপ্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় সাধারণত তিন ধরনের পরিবর্তন ঘটছে: উচ্চারণগত, শব্দভান্ডারগত এবং অনেকেরই নিজস্ব লিপি না থাকায় লোকসাহিত্য সীমিত হয়ে যাওয়া। যাদের লিপি আছে, তারাও সেটি চর্চার সুযোগ পাচ্ছে না। যেমন চাকমাদের নিজস্ব লিপি আছে, কিন্তু তাদের ৯৫ শতাংশই সেটি লিখতে ও পড়তে পারে না। এ কারণে তাদের অধিকাংশ সাহিত্যই রচিত হচ্ছে বাংলা হরফে। অনলাইনেও তারা বাংলা ও রোমান হরফে মাতৃভাষা চর্চা করছেন। জাতিগোষ্ঠীর বয়স্ক মানুষেরা মুখে মুখে প্রচলিত যেসব গল্পগাথা ও লোকজ্ঞান প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতেন, তার চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ থাকলেও দেশের ৯৭ শতাংশই বাঙালি। জাতিগোষ্ঠীগুলোর ওপরে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রবল প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। অতি সম্প্রতি অবশ্য সরকারি উদ্যোগে পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও সাদ্রি- এই পাঁচ ভাষায় প্রাক- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই রচনা করেছে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। তবে নানা জটিলতায় তা এখনো ফলপ্রসূ হয়নি।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ঘোষণা অনুসারে মাতৃভাষায় শিক্ষা পাওয়ার অধিকারের অংশ হিসেবে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৫ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর জন্য পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়েছে। এ থেকে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার দিকটিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করার কথা ছিল। তাতে মণিপুরি ভাষাও অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কথা কিন্তু অবস্থা তথৈবচ। শিক্ষা ব্যবস্থা চালুতো দূরে থাক, আজ পর্যন্ত পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, অভিনয় শিল্পীদের প্রতিভা যাতে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে, শিল্পীদের পণ্যসামগ্রী যেন ঠিকমতো বিপণন হয়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। সুসম সমাজ গঠনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে আমাদের মাতৃভূমিতে। বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের মধ্যে অধিকাংশের ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। লিখিত রূপ না থাকায় তাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, তবে মণিপুরি ভাষার অবস্থায় রয়েছে ব্যতিক্রম। মণিপুরি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাতো রয়েছেই, অধিকন্তু রয়েছে উর্বর সাহিত্য ভান্ডার ও নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে তোলা প্রশিক্ষিত শিক্ষক মন্ডলী।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হচ্ছে সকল জনগোষ্ঠীর ভাষার সংরক্ষন। এ দায়িত্ব শুধু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নয়, পৃথিবীর সব মানুষের। আমরা শুধু আবেগতাড়িত হয়ে অমর একুশের কথা না বলি। যখন প্রত্যেক জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারবে, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে, তখনই সার্থক হবে ভাষা আন্দোলনের চেতনা। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এসব ভাষা রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই)। ইতোমধ্যে ভিন্ন ভাষার (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা) মধ্য থেকে কয়েকটি ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে তারা।সংরক্ষণের নানা বিষয়ে চলছে গবেষণা। আমরা এ কাজের সফলতা কামনা করি।
হাজী মো. আবদুস সামাদ
(লেখক ও গবেষক)
জৈন্তাবার্তা/জেএ