সুরমা নদী ভাগ করে রেখেছে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলাকে। সীমান্তবর্তী এই উপজেলার যে অঞ্চলটির মানুষ জেলাসদরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সবজি পেঁৗছে দেবার কাজ করেন, তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন এই সময়েও। সরকারি হিসেবে ওই অঞ্চলে কেবল শীতকালীন সবজি উৎপাদন হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকার। স্থানীয় সবজি চাষীদের দাবি, যোযোগের অব্যবস্থার কারণে প্রতিবছর সবজি থেকেই কেবল দশ কোটি টাকা মূল্য কম পান তারা। এছাড়া মাছ, ধানসহ অন্যান্য উৎপাদিত পণ্যও বাজারজাতের ভোগান্তিতে থাকেন ওপারের পাঁচ ইউনিয়নের কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ। সোমবার সুরমা নদীর কাক্সিক্ষত ওই অংশে সেতু নির্মাণের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং হাইড্রোলজি—মরফোলজি স্টাডি শুরু হওয়ায় এলাকাবাসী আনন্দে উদ্বেলিত। তবে সেতুর কাজটি আদৌ কবে হবে, এই নিয়েও উৎকণ্ঠা আছে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে।
সুরমার উত্তরপাড়ের ষোলঘর এলাকার বাসিন্দা আক্কাছ আলী বললেন, আমাদের উৎপাদিত সবজি সিলেট অঞ্চল ছাড়িয়ে রাজধানী ঢাকায় যায়। কিন্তু ক্ষেতের সবজি প্রথম হালুয়ারঘাটে নদীর পাড়ে নিয়ে যাই আমরা। পরে লেবার দিয়ে নামানো হয়। আবার নৌকায় তুলে পার করে নিয়ে পরিবহনে তুলতে হয়। তাতে টাকা খরচ হয়, সময়ও ক্ষেপন হয়। অথচ সারাদেশে এখন জমি থেকেই কৃষি পণ্য বিক্রয় হচ্ছে।
সুরমা নদীর উত্তরপাড়ে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইউনিয়নগুলো হচ্ছে সুরমা, জাহাঙ্গীরনগর ও রঙ্গারচর। এছাড়া এই পথ দিয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ও লক্ষীপুর ইউনিয়নেরও কিছু এলাকার মানুষ যাতায়াত করছেন ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ৩৮০ হেক্টর জমিতে প্রতি শীত মৌসুমে ৩০ কোটি ৪০ লাখ টাকার, সুরমা ইউনিয়নের ১৯০ হেক্টর জমিতে ১৫ কোটি ২০ লাখ টাকার এবং রঙ্গারচর ইউনিয়নের ৩০ হেক্টর জমিতে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকার সবজি উৎপাদন হয়। দোয়ারাবাজারের বাংলাবাজার ইউনিয়নে ৬০০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত ৪৮ কোটি টাকার সবজি ও লক্ষীপুর ইউনিয়নের ৭০ হেক্টর জমির আট কোটি ৬০ লাখ টাকার সবজির একটি অংশ এই পথ দিয়ে জেলা সদরে আসে। এছাড়া এই ইউনিয়নগুলোতে উল্লেখ করার মতো মাছের খামারিও আছেন, যারা দুর্গম এই পথ দিয়ে মাছ এনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রয়ের জন্য পাঠান।
মঙ্গলকাটা বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুর রব জানান, সুরমা নদীর ধারারগাঁও—হালুয়ারঘাট এলাকায় সেতু হলে কেবল সদর উপজেলার উত্তরপাড়ের তিন ইউনিয়নের চাষীরা সবজি বিক্রয় করে দশ কোটি টাকা বেশি পাবেন। এখন যে সবজি বিক্রয় করে কেজি প্রতি পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে চল্লিশ টাকা পান, সেই সবজি জমি থেকেই ৫০ টাকা কেজিতে চাষীগণ বিক্রয় করতে পারবেন। মাছের ক্ষেত্রে এভাবেই ঠকছেন খামারিরা।
তিনি বললেন, সবজি চাষি ও মাছের খামারিরা যখন তাদের উৎপাদিত সবজি—মাছ বাজারে নিয়ে যায়, তখন পাইকাররা ইচ্ছে করেই দাম কমিয়ে নেয়, তারা বুঝে এটি বিক্রয় করতেই হবে ওই চাষিকে। অথচ ট্রাক সরাসরি জমিতে যেতে পারলে যাচাই করে সবজি তুলে বিক্রয় করতে পারতেন চাষীরা। এছাড়া এই সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ উপত্যকা রয়েছে। এখানে পর্যটকরাও অনেক কষ্টে আসেন। সেতু হলে তারা সরাসরি এখানে আসতে পারবেন। এই সীমান্তে ইমিগ্রেসনসহ শুল্কস্টেশন করার দাবি আছে। সেতু হলে শুল্কস্টেশন হবার বিষয়টিও এগিয়ে যাবে।
সুরমার উত্তরপাড়ের বৈষেরপাড়ের আবু তারেক বললেন, কয়েকদিন আগে এক তরুণ বিষ খেয়েছিল। গ্রাম্য চিকিৎসকরা বললেন, দ্রুত সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। স্বজনরা ছেলেটিকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই রওয়ানা দেন। হালুয়ারঘাট খেওয়া ঘাটে এসে দেখেন খেওয়া নৌকা দক্ষিণপাড়ে। ওখানে বিলম্ব হওয়ায় ছেলেটিকে নদী পার করতে করতেই মারা যায়। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
দক্ষিণপাড়ের কোরবাননগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল বরকত বললেন, উত্তরপাড়ের তিন ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ যুগযুগ ধরেই যোগাযোগ কষ্টে ভোগছেন। বর্ষায় এই দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। ইতিপূর্বে বহুবার নৌকাডুবিতে শিক্ষার্থীদেরও প্রাণহানি ঘটেছে।
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজা বললেন, উত্তরপাড়ের মানুষ খাদ্যপণ্য যোগান দেয়। কিন্তু দেশের চলমান উন্নয়ন থেকে তারা বঞ্চিত। দক্ষিণপাড় বদলে গেলেও উত্তরপাড়ের মানুষ ৫০ বছর আগে যে যোগাযোগ কষ্টে ভুগেছে, এখনও সেভাবেই আছে। এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ সাদিক সরকারি উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা থাকার সময় থেকেই এখানে সেতু হবার জন্য কাজ করেছেন। গেল জাতীয় নির্বাচনে এই সেতু করার আশ^াস দিয়ে তিনি ভোটারদের সমর্থনও নিয়েছেন, আমরা আশা করছি তিনি মানুষের প্রাণের দাবি বাস্তবায়ন করতে পারবেন।
সোমবার থেকে ধারারগাঁও—হালুয়ারঘাট এলাকায় এলজিইডি’র নিয়োগপ্রাপ্ত কনসালটেন্টরা ফিজিবিলিটি ও হাইড্রোলজি—মরফোলজি স্টাডি শুর” করেছেন।
এই কাজে নিয়োজিত কনসালটেন্ট মো. মুরাদ হোসেন বললেন, দেশের একশ সেতুর ফিজিবিলিটি স্টাডি ও হাইড্রোলজি—মরফোলজি স্টাডি শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জের হালুয়ারঘাট এলাকায় ৮৫০ মিটার লম্বা সেতু করার পরিকল্পনা নিয়ে এলজিইডি প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছে। সোমবার থেকে আগামী কয়েকদিন মাটি—পানি পরীক্ষা ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা হবে। ওখানে জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন কেমন, সরকারি জমি আছে কী—না, সেটি যাচাই করা হবে।
সুনামগঞ্জ এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বললেন, বড় সেতু করার আগে যে সকল কাজ করা লাগে সেটি শুরু হয়েছে ধারারগাঁাও—হালুয়ারঘাট এলাকায়। এরপর সয়েলটেস্ট শেষ করে ডিজাইনের কাজ হবে। যেভাবে এই সেতুর জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ সাদিক সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতনদের সঙ্গে লেগে আছেন, আশা করি সেতু হবে।
জৈন্তাবার্তা/এমকে