ভাঙছে একান্নবর্তী পরিবার বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা
শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:২১

বিশ্ব পরিবার দিবস আজ

ভাঙছে একান্নবর্তী পরিবার বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা

মো. ফয়ছল আলম

প্রকাশিত: ১৫/০৫/২০২৪ ১২:২৩:২১

ভাঙছে একান্নবর্তী পরিবার  বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা



রোববার সিলেটের গোলাপগঞ্জে বাচ্চু মিয়া নামের যে যুবকের মৃত্যু হয়েছে এর নেপথ্যে রয়েছে পারিবারিক বিরোধ। বাচ্চু মিয়ার বাবা ও চাচা এক পরিবারেই বড় হয়েছেন। খাবার খেয়েছেন একই টেবিলে। কিন্তু দ্ইু পক্ষের সংসারে সম্পদ আর সন্তান সন্ততি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধও বাড়তে থাকে। আর সে বিরোধের সর্বশেষ পরিণতি বংশের টগবগে তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু। 

পারিবারিক বিরোধে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা এখন নিয়মিতই ঘটছে। বিশ্ব পরিবার দিবসে বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ আর সমাজ বিজ্ঞানীরা পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন মাদক, সন্ত্রাস, কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধসহ নৈতিক অবক্ষয়ের যত ঘটনা ঘটছে এর মূলে কাজ করছে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হওয়ার সংস্কৃতি। 

যে স্মৃতি তাড়া করে ফিরে সবাইকে: পরিবারগুলোতে একসময় দারুণ একাত্মতা ছিল। সবাই যখন একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসতেন তখন অন্যরকম আনন্দ মিলতো। বাবা কিংবা দাদা মাঝখানের চেযারে বসে দেখতেন, আর উপভোগ করতেন। কেউ বাজারে যেতেন, কেউ সন্তানদের লেখাপড়ার দিকে খেয়াল রাখতেন। বড় জা’র ছেলে বা মেয়েকে ছোট জা গোসলে নিয়ে যেতেন, ঘুম পাড়াতেন। আবার বিকেলবেলা ননদ, জা রা একে অপরের চুলে বিলি দিতেন। একভাইয়ের ছেলে অসুস্থ হলে অন্যভাই পাগলপারা হয়ে যেতেন। ডাক্তারের কাছে ছুটে যেতেন। এরকম নানা মেলবন্ধন আর ভালোবাসা মিশ্রিত এক বাক্যের রূপায়ন ‘একান্নবর্তী পরিবার’। এ পরিবারগুলো থেকেই সমাজে শান্তির বার্তা ছড়াতো। ভালোবাসা- সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন থাকে একান্নবর্তী পরিবারগুলোতে। কিন্তু সারাদেশের মতো সিলেটেও একের পর এক ভাঙছে একান্নবর্তী পরিবার। যে পরিবারগুলোকে অনেকে এখনও আদর্শ পরিবার বলেন। কিন্ত কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে সেসব ঐতিহ্য। একান্নবর্তী পরিবারগুলো শুধু ভাঙছেই না, বরং হিংসা সেখানে এমন জায়গায় পৌছাচ্ছে যে, খুনোখুনি পর্যন্ত হচ্ছে। যে বাড়ির উঠোনে ছোট্ট শিশুরা এক প্রান্ত থেকে দৌড়ে অপর প্রান্তে যেতে হাফিয়ে উঠতো। দাদা-দাদি, বাবা-চাচা আর ফুফুদের কোলে গিয়ে আশ্রয় পেতো, সেসব বাড়ির উঠোনে এখন একের পর এক দেয়াল। কথিত নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বাড়ির পাশে উঠছে দেয়াল। উঠছে সুউচ্চ গেইট। কোথাও আবার বাড়ির পুকুরটাও হারিয়েছে অস্তিত্ব। এরকম নানা ঘটনার প্রভাব পড়ছে সমাজে। ফলে সবখানেই বিশৃংখলা আর হানাহানি। 

পারিবারিক বন্ধন ভাঙার বেশি খবর মিলে সিলেটের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার আর এসএমপির কার্যালযে। আদালতপাড়ায়ও এ ধরনের খবর পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়ে প্রশাসনের দপ্তরে। এসব অভিযোগের বেশিরভাগই পারিবারিক বিরোধের জের ধরে- এমন তথ্য দরখাস্তগ্রহীতাদের। শুধুু এসব জায়গা নয়, প্রবাসী কল্যাণ সেলেও জমা পড়ে পারিবারিক বিরোধের নানা অভিযোগ। ছিনতাই চাঁদাবাজির ঘটনা তদন্তের পরও দেখা যায় অনেক ঘটনার নেপথ্যে থাকে পারিবারিক বিরোধ। আর এসব পারিবারিক বিরোধের মূল দ্বন্দ্ব জমিজমা আর অর্থকড়ি নিয়ে। 

সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সম্রাট তালুকদার দৈনিক জৈন্তাবার্তার কাছে পারিবারিক এসব বিরোধের কথা স্বীকার করে বললেন, পারিবারিক বিরোধের জেরেই বেশি অভিযোগ জমা পড়ে। সেগুলো দেখেন এডিশনাল এসপি (ক্রাইম)। 

সিলেট জেলা জজ আদালতের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জৈন্তাবার্তাকে বলেন, এটি অত্যন্ত দুখের একটি বিষয়। সিলেট অঞ্চলে পারিবারিক শৃঙ্খলা খুব বেশি ছিল। যে কারণে সমাজে শান্তিও ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন তার উল্টো চিত্র দেখছি। আদালতে যেসব মামলা দেখছি এর বেশির ভাগের মূলেই রয়েছে নানা পারিবারিক বিরোধ। পারিবারিক বিরোধ যত বাড়বে, সামাজিক শৃঙ্খলা ততই বিনষ্ট হবে, অপরাধ বাড়বে, বাড়বে নৈতিক অবক্ষয়ও। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।  

এ ব্যাপারে এসএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (মিডিয়া) সাইফুল ইসলাম জৈন্তাবার্তাকে বলেন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির পেছনে অনেকটাই ভূমিকা রাখছে পারিবারিক বন্ধন না থাকার বিষয়টি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ সময় একান্নবর্তী পরিবারের সন্তানরা নিয়ন্ত্রণে থাকতো। এখন সেই নিয়ন্ত্রণ নেই। গরিবেরা তাদের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না অর্থনৈতিক কারণে। আর ধনীরা পারছেন না প্রাচুর্যের কারণে। পরিবারের সন্তানরা আগে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ঢুকতো। এখন রাতে বাইরে আড্ডা মারে। জড়ায় নানা অপরাধেও। 

এলএইচ