
প্রতীকী ছবি
দেশে বিনিয়োগের খরা কাটছেই না। উল্টো তলানিতে থাকা বিনিয়োগ আরো কমেছে। বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে সব সময় আশার কথা শোনানো হলে বাস্তবতা বলছে ভিন্নকথা। বিনিয়োগ কম হওয়ার বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে অর্থনীতিতেও। নানান চেষ্টায়ও বাড়ছে না বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। এসব কারণে লেনদেনের ভারসম্যহীনতায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। আগামী দিনে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ছাড়া বিনিয়োগের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে না বলে মনে করছেন বহু বিনিয়োগকারী। এই পরিস্থিতি উত্তরণে বিদেশি বিনিয়োগ বাস্তবায়নে নজর দিতে বলছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে নেট ৮২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বাংলাদেশে। আগের অর্থবছরের একই সময় ১০৩ কোটি ২০ লাখ ডলার এসেছিল। সে হিসাবে আট মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২০.১৫ শতাংশ। বছরের হিসেবে ২০২৪ সালে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম নেট এফডিআই এসেছে বাংলাদেশে।
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট, ডলার ঘাটতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। বিশেষ করে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে স্পেশাল ইকোনমিক জোনে এসব সেবা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কষ্টকর। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি ব্যবসার মুনাফা নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যেতে না পারেন তাহলে তাঁরা নিরুৎসাহিত হবেন। সর্বোপরি আমাদের দ্রুত একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দিকে এগোতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক বিবেচনায়ও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। ২০২৪ সালে দেশে মোট নিট এফডিআই এসেছে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে এই অঙ্ক ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার কমেছে এফডিআই।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী জানান, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে খুব বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। এরপর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আগস্টে সরকার পতন ঘটে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। যদিও বছরের শেষ দিকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এই অনিশ্চয়তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় ফেলে দিয়েছে, যার কারণে বিনিয়োগ কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে নিট এফডিআই এসেছিল ১.৫৭ বিলিয়ন ডলার, এরপর থেকে প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় এফডিআই কমেছে। সব মিলিয়ে ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিএমপি৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিভাইজড ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে এসেছে সবচেয়ে কম এফডিআই।
২০২৪ সালে আসা মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ৬২২ মিলিয়ন ডলার ছিল রিইনভেস্টেড আর্নিংস অর্থাৎ পুরনো বিনিয়োগ থেকে আয় আবার বিনিয়োগ করা। এটি মোট এফডিআইয়ের প্রায় ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া ইক্যুইটি ক্যাপিটাল এসেছে ৫৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন বা আন্ত কোম্পানি ঋণ এসেছে ১০৪ মিলিয়ন ডলার।
রি-ইনভেস্টমেন্ট কেন বেশি জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগে রিটার্ন ভালো। তবে বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় ডলার সংকট ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতায় আয় ফিরিয়ে নিতে পারেন না, তাই বাধ্য হয়ে পুনর্বিনিয়োগ করেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্যাংকিং খাতে-৪১৬ মিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাত-৪০৭ মিলিয়ন ডলার। ওষুধ ও রাসায়নিক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি এবং খাদ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এসেছে।
এদিকে, চলতি এপ্রিলে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটি (বেজা) যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’ আয়োজন করে। বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, এই সামিটে ৫০টি দেশের ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশ নেন। এই আয়োজন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।
এই সামিটের সুফল কবে আসতে পারে জানতে চাইলে একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী জানান, ‘সামিটের পর বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করেন। এতে সময় লাগে। সব কিছু অনুকূলে থাকলে বিনিয়োগ আসতে অন্তত এক বছর লাগবে। নতুন সরকার যেসব আর্থিক খাত সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলো সবার মতামতের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে খাতভিত্তিক স্বচ্ছতা বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় বসলে নিয়ম-নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরা বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিনিয়োগ সম্মেলনে যেমন আলোচনা হয়েছে সেগুলো দেখে আমরাও মাঝে মাঝে আশাবাদী হই। কিন্তু যখন আবার নিজেদের দিকে তাকাই, তখন হতাশ হই। আমরা কি ভালো আছি? আমরা তো ভালো নেই। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কী দেখে আসবেন? তাঁরা তো আমাদের দিকে আগে দেখবে। সেই দেশের বিনিয়োগকারীরা কেমন আছে? আবার আগে যেসব বিদেশি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা কেমন আছেন, সেটাও তাঁরা দেখবে।
জৈন্তা বার্তা/আরআর
