অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে ৩১ মে বন্ধ হয়ে গেছে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার। এর আগেও একই অভিযোগে দুইবার বন্ধ হয়েছিল জনশক্তি রপ্তানির নিরিখে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ এই শ্রমবাজার। শ্রমবাজার বন্ধের মূল কারণ দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট। অন্যদিকে শ্রমিকদের সঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালদের প্রতারণা। এ-সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে। এমনকি নাম ধরেই প্রকাশ হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে কমিটি হলেও অপরাধীরা শাস্তি পাবে কি না তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানে দেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। বিদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধের খবরে অনেকেই হতাশ হয়েছেন, বিশেষ করে যারা সে দেশে কাজ করতে আগ্রহী। এজন্য শ্রমিকদের অনেকেই তাদের শেষ মূল্যবান সম্বলটুকু বন্ধক রেখে বা বিক্রি করেও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। প্রতারণার শিকার হয়েছেন সিন্ডিকেটের কারসাজি ও দুর্নীতির, যা এক ধরনের অপরাধ। অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজারে। দেশের শ্রমবাজার বাঁচাতে ও ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো আমাদের দেশের শ্রমবাজার আরো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
চক্র তৈরি করে কর্মী পাঠানোর অনিয়মের অভিযোগে ২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষে খোলা হয় বাজারটি। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র গড়েছিল। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে বাংলাদেশিদের জন্য আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। তখন আবারো চক্র সৃষ্টি করা হয়। গত মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, দেশটি আপাতত আর শ্রমিক নেবে না। যারা অনুমোদন পেয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, তাদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে হবে। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের সে দেশে প্রবেশের শেষ দিন ছিল ৩১ মে। কর্মিভিসায় ৩১ মের পর আপাতত আর কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাই ওইদিন ঢাকা বিমানবন্দরে হাজারো মানুষের ভিড় দেখা যায়।
শ্রমবাজার বন্ধের দিনে প্রায় ৩২ হাজার মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কর্মী দালাল-এজেন্সির প্রতারণায় দেশটিতে যেতে পারেননি। এ বিদেশগামী প্রত্যেকটি মানুষ ঋণ করে ৫-৬ লাখ টাকা দালাল ও এজেন্সিকে দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তারা নিরুপায় হয়ে বিমানবন্দর থেকে হতাশা নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন। এ মানুষগুলো এখন কীভাবে ঋণ শোধ করবেন, তার উত্তর নেই কারো কাছে। আবার কত বছর পর দ্বার খুলবে এ শ্রমবাজারের, তারও নিশ্চয়তাও নেই। তবে ঝুলে যাওয়া কর্মীদের বিষয়ে সরকার উদ্যোগী হলে সমাধান হতে পারে। একই সঙ্গে প্রতারক ও সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করাও জরুরি।
গত দুই বছরে অভিবাসী শ্রমিকদের অর্ধেকের গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। এসব শ্রমবাজারে শ্রমিকের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে একেবারেই বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। এর প্রধান কারণ দালাল-সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। যাদের প্রতারণায় বিদেশগামীরা কয়েক লাখ টাকা খরচ করে দেশ ছাড়লেও পর্যাপ্ত কাজ পাচ্ছেন না। হয়রানির শিকারও হচ্ছেন। এমনকি অনেকে কাজ না পেয়ে হতাশা নিয়ে দেশে ফিরছেন। দেশে ফিরে দেনার দায়ে তাদের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। ফলে রেমিট্যান্স কমছে।
মালয়েশিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রত্যেক শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব স্বাগতিক দেশের। সেই দায়িত্ব মালয়েশিয়া কিংবা অন্যান্য দেশ কতটা পালন করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রোধে বাংলাদেশেরও করণীয় আছে বলে মনে করি। অন্তত সমস্যাগুলো নিয়ে স্বাগতিক দেশগুলোর সঙ্গে সরকার আলোচনা করতে পারে।
মালয়েশিয়া কেন বিদেশী কর্মী নিয়োগ বন্ধ করল, তার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। বস্তুত সিন্ডিকেটের কারণে অতীতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ-সংক্রান্ত সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এ সিন্ডিকেটের কারণে দেশের সব এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায় না; সুযোগ পায় কিছুসংখ্যক এজেন্সি। তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেক শ্রমিকই বেকার থাকছেন। কাজেই এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে বিদেশে যেতে আগ্রহী কর্মীরা বারবার প্রতারণার শিকার হবেন।
এলএইচ