দিল্লি থেকে শেখ হাসিনার অন্য কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি
শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৫

দিল্লি থেকে শেখ হাসিনার অন্য কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি

জৈন্তা বার্তা ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩/০৯/২০২৪ ০৮:৪৬:০৩

দিল্লি থেকে শেখ হাসিনার অন্য কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি

সংগৃহীত


বাংলাদেশে যখন ছাত্র গনঅভ্যুথানের আন্দোলন বিদ্রোহের রূপ ধারণ করল তখন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়লে তিনি ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারত চলে আসেন। তাকে নিয়ে আসা বিমান দিল্লির সন্নিকটে গাজিয়াবাদে হিন্ডন এয়ারবেসে অবতরণ করে। হাসিনাকে এক নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। দু-তিন দিন পর খবর এলো, তিনি সেখানে এক শপিং কমপ্লেক্সে কিছু কেনাকাটা করেছেন। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত তার সম্পর্কে আর কোনো খবর নেই। কারো এ কথাও জানা নেই যে, তিনি হিন্ডন এয়ারবেসে আছেন, নাকি তাকে দিল্লিতে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ আগস্ট তিনি একটি বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ন্যায়বিচারের আবেদন করেন তিনি।

তিনি বলেন, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও লুটতরাজে লিপ্ত, তদন্তপূর্বক তাদের শাস্তি দেয়া হোক। তার এই বিবৃতি বাংলা ভাষায় ছিল, যা আমেরিকায় বসবাসরত তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে শেখ হাসিনা এ কথাও বলেন যে, জুলাই থেকে চলা সহিংসতায় বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের কর্মী ও সাধারণ মানুষ তাদের জীবন হারিয়েছেন। তিনি তাদের মৃত্যুতে সমবেদনা প্রকাশ করেন। তার এ বিবৃতির কয়েক দিন পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ওই বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, ভারতের মাটিতে বসে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য বন্ধুসুলভ নয়। তার বক্তব্যে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা নয়াদিল্লির কাছে শেখ হাসিনাকে প্রত্যার্পণের আবেদন না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উভয় দেশকে অস্থিরতায় ফেলা থেকে তার বিরত থাকা উচিত। তার বক্তব্য ভারতের জন্যও উপযুক্ত নয়, বাংলাদেশের জন্যও নয়। তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মুহাম্মদ ইউনূস আরো বলেন, প্রত্যার্পণের আবেদন পর্যন্ত ভারত শেখ হাসিনাকে তাদের কাছে রাখতে চাইলে রাখুক। তবে সে সময় হাসিনাকে নিশ্চুপ থাকতে হবে। কিন্তু হাসিনা বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, যা চিন্তার বিষয়। তাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আর তিনি সেখান থেকে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে ভারতে আসেননি। তিনি গণঅভ্যুত্থান ও অসন্তোষে পালিয়ে এসেছেন। ভারত সরকার তার এ বিবৃতির বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। তবে মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত মর্ম থেকে এ ফল বের করা যায় যে, তিনি ভারতে হাসিনার অবস্থানে খুশি নন। সম্ভবত তিনি চাচ্ছেন, ভারত হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করুক।

এ দিকে আরেকটি ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভারতের কাছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণ চাচ্ছেন। আদালতের চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। স্মর্তব্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ২০১০ সালে গঠন করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধগুলোর তদন্ত করা। অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা। কিন্তু এখন সেই ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাচ্ছে।


হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আকারে মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বন্দী ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আরো বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের অপরাধী বিনিময়ের চুক্তি রয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১৩ সালে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয়। যেমনটা আপনাদের জানা আছে, হাসিনাকে বাংলাদেশের গণহত্যার মূল আসামি অভিহিত করা হয়েছে। এ কারণে আমরা তাকে আইনিভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চেষ্টা করব, যাতে তাকে তার বিরুদ্ধে করা মামলার মুখোমুখি করা যায়।

জানা থাকা ভালো যে, শেখ হাসিনা যখন ভারতে আসেন, তখন এমন সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল যে, তিনি ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা কাতারে রাজনৈতিক আশ্রয় নেবেন। কিন্তু যেহেতু তিনি এক ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতক প্রধানমন্ত্রী, সে কারণে কোনো দেশের পক্ষে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া সহজ নয়। ফলে কেউ এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। এ কারণে আশ্রয় অর্জনের তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকা তার ক‚টনৈতিক পাসপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। মোট কথা আমেরিকা তার প্রতি খুশি নয়। যেভাবে নির্বাচনের সময় তিনি বিরোধীপক্ষকে দমন করেছেন এবং বাহ্যত বিরোধীপক্ষ ছাড়া নির্বাচন করেছেন, এতে আমেরিকা নারাজ ছিল। তখন এই সংবাদ এলো, শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে আমেরিকার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তবে পরবর্তীতে এ সংবাদ প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভারতকে হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করা হয়। এমনিতে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক সর্বদা বন্ধুসুলভ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে এ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। প্রতিটি বিতর্কিত নির্বাচনের পর হাসিনা তথাকথিত বিজয় লাভ করেন, ভারত তখন তাকে ধন্যবাদ জানায়। এ কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা মনোভাব সৃষ্টি হয় এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা যুক্ত আছেন, তারাও ভারতের প্রতি অসন্তুষ্ট। স্বয়ং মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের দ্বারা তার অসন্তোষের আঁচ পাওয়া যায়।

মুহাম্মদ ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছেন, তার সরকার শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণের দাবি জানাবে। ট্রাইব্যুনাল স্পষ্ট করে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি বাংলাদেশ হাসিনার প্রত্যার্পণের দাবি জানালে ভারত কী করবে? দিল্লি কি হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যার্পণে অস্বীকৃতি জানাবে, নাকি তাকে সেখানে পাঠাবে?


আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, যদি এমন হয়, তাহলে ভারতকে বাংলাদেশের হাতে হাসিনাকে প্রত্যার্পণ করতে হবে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, উভয় দেশের মধ্যে প্রত্যার্পণের চুক্তি রয়েছে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, তিনি ভারতে পালিয়ে এসেছেন। তৃতীয় কথা হচ্ছে, এক দেশের সাথে আরেক দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক শাসক ও রাজনীতিবিদদের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় না, বরং সরকার বা রাষ্ট্রের ভিত্তির ওপর তৈরি হয়। এমতাবস্থায় যদি ভারত হাসিনাকে নিজের কাছে রাখতে জেদ ধরে, তাহলে এটা হবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অনেক বড় ব্যর্থতা। আর যদি ভারত হাসিনাকে প্রত্যার্পণ করে, তাহলে তার সাথে ভারতের বন্ধুত্বের কী হবে?

স্মরণযোগ্য যে, যখন হাসিনার বাবা শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহেনাসহ দেশের বাইরে ছিলেন। তখন তিনি কয়েক বছর দিল্লিতে নীরবে দিন কাটান। এবারো যদি তিনি নীরব-নিশ্চুপ থাকতেন, তাহলে সম্ভবত বাংলাদেশের সরকারও নীরব থাকত। কিন্তু তিনি একটি বক্তব্য দিয়ে মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ার মতো কাজ করেছেন। এখন ভাবভঙ্গিমায় বোঝা যাচ্ছে, ওখানকার সরকার তাকে প্রত্যার্পণের দাবি জানাবে। যদি তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়, তাহলে হাসিনার পরিণতিও তেমন হবে, যা তিনি বিরোধীপক্ষের নেতাদের সাথে করেছেন। যেভাবে তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়াকে বছরের পর বছর জেলে বন্দী করে রেখেছেন, সেভাবে তাকেও জেলে নিক্ষেপ করা হবে। এ মুহূর্তে কোনো দেশ এমন নেই, যারা তার প্রতি দরদ দেখাবে। একমাত্র ভারত এমন এক দেশ, যে তার বন্ধু। এ কারণে যদি তাকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়, কিংবা গণহত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, যেমনটা তিনি বহু নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, তখন কি অন্য কোনো দেশ এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে? এর সম্ভাবনা খুব কম। এ দিকে ভারতের জন্য আরো একটি সমস্যা রয়ে গেছে, যদি তারা হাসিনাকে কাছে রাখতে জেদ করে, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে দিল্লির সম্পর্ক ভালো থাকবে না। এমনিতে ভারত কখনো জামায়াতের নেতাদের ও খালেদা জিয়াকে বন্দী করে রাখার বিরোধিতা করেনি। সাথে এটাও এক বাস্তবতা যে, শেখ হাসিনা ভারতীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। তাদের ধরে ধরে ভারতের কাছে তুলে দেন। যার কারণে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ কমে যায়। মুহাম্মদ ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে এ কথাও বলেছেন, ভারতকে হাসিনার বানোয়াট ওই বক্তব্য থেকে দূরে থাকতে হবে যেখানে শেখ হাসিনা বলেছেন, শুধু তিনি সেক্যুলার আর বাকি সব নেতা ইসলামিস্ট। বলাবাহুল্য মুহাম্মদ ইউনূস ওখানকার বিরোধীপক্ষ ও জামায়াতের ব্যাপারে ভারতের নীতির বিরোধিতা করছেন।

এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনা ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে কি দিল্লির সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে? এমনিতে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন সে পর্যায়ের নেই, যা শেখ হাসিনার সময় ছিল। এখন এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় প্রদান ভারতের জন্য কঠিন বোঝা হয়ে যাচ্ছে। ভারত সে সময় সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারবে, যখন দিল্লি প্রত্যার্পণের দাবি মেনে নেবে।

জৈন্তাবার্তা / এআর