
ছবি : সংগৃহীত
সিলেট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে দালাল চক্রের দৌরাত্ম থামছে না। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন পাসপোর্ট আবেদন অনলাইনে (ই-পাসপোর্ট) সম্পন্ন করা গেলেও আবেদনকারীরা প্রতিদিনই নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন দালালদের কারণে। কৌশল পাল্টে আরও সুপরিকল্পিতভাবে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ।
নগরীর আলমপুরে অবস্থিত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে ফটোকপির দোকানগুলো এখন দালালদের কেন্দ্রবিন্দু। এসব দোকানের সঙ্গে রয়েছে অলিখিত ‘চুক্তি’। সহজ-সরল গ্রামগঞ্জ থেকে আসা পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে।
আবেদন ফরম পূরণ, জন্ম নিবন্ধনের অনলাইন ভেরিফিকেশন, অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে পিতা-মাতার অনুমতি পত্রসহ নানা কাগজপত্রের নাম করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে দালালরা। পাসপোর্টের আবেদন এখন অনলাইনে (ই-পাসপোর্ট) হওয়াতে অধিকাংশ পাসপোর্ট প্রত্যাশী এই নিয়মের সাথে অপরিচিত। মূলত এই সুযোগ নিচ্ছে দালালরা। পাসপোর্ট অফিসের বাইরের ফটোকপির দোকানগুলোতে ফরম পূরণের নামে আবেদনকারীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এই টাকার ভাগ পান দালাল, ফটোকপির দোকানের মালিক ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে কর্তব্যরত আনসার সদস্য, পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহায়ক, সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল অপারেটর এদের আলাদা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এদের মধ্যে থেকে বাইরের দালালদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে অফিস সহায়ক সিন্ডিকেট। কোনো আবেদনকারীর আবেদন ভুল কিংবা ফাইল অসম্পূর্ণ থাকলে সহায়তার জন্য অফিস সহায়ক সিন্ডিকেটের সদস্যরা এগিয়ে আসে। তারা আবেদনকারীকে বাইরের ফটোকপি দোকানগুলোতে যেতে বলে। আবেদনকারী দোকানে পৌঁছানোর পূর্বেই তারা ফোনে দালালদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়। এরপরই শুরু হয় গলাকাটা ব্যবসা। বিভিন্ন ফরমের নামে আবেদনকারীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
আবেদনকারীদের অভিযোগ, দালালের সহায়তা ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন করা হলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। আর দালাল ধরলে আবেদনগুলোতে ‘বিশেষ চিহ্ন’ দেওয়া থাকে। চিহ্নধারী আবেদনকারী ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলায় অগ্রাধিকার পাওয়াসহ দ্রুত পাসপোর্ট পান। বিড়ম্বনা এড়াতে অনেকেই বাধ্য হয়ে দালাল মারফত আবেদন জমা দেন।
জকিগঞ্জ উপজেলার খলাছড়া গ্রামের কৃষক তছির আলী। সিলেট আলমপুর পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমা দেওয়ার জন্য আলমপুরের এক কম্পিউটার দোকানদারের মাধ্যমে অনলাইনে ফরম পূরণ করেন। বিনিময়ে তাঁর কাছ থেকে নেওয়া হয় ১, ৫০০ টাকা। দোকানদার তছির আলীকে জানান, পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ফরম জমা দিলে ডেলিভারি কপি দেবে। কয়েক দিন পর এসে এই কপি দিয়ে পাসপোর্ট নিতে পারবেন। কম্পিউটার দোকানদারের কথামতো ফরম জমা দিতে এসেই তছির আলী পড়েন বিপাকে। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা বলেন, ফাইল অসম্পূর্ণ। জন্ম নিবন্ধনের অনলাইন ভেরিফিকেশন লাগবে। তছির আলী আবারও সেই কম্পিউটার দোকানদারের কাছে যান। পরে আরও ৩০০ টাকা দিয়ে সেই কাগজ তুলে আনেন তছির আলী।
নগরীর আখালিয়াঘাট এলাকার বাসিন্দা সজীব আহমদ বলেন, ‘আমি নিজে নিজে অনলাইনে আবেদন করি। যেদিন জমা দেব, সেদিন প্রিন্ট আউটের জন্য আলমপুর পাসপোর্ট অফিসের শাহজালাল কম্পিউটার দোকানে যাই। কম্পিউটারের সামনে বসা এক ব্যক্তি আমার আবেদন দেখে বলেন আবেদন হয়নি। জমা দিতে গেলে বাতিল হয়ে যাবে। আমি ঘাবড়ে গেলাম।’ ততক্ষণে পাশে বসা আরেকজন বললেন, ‘সমস্যা নেই। সামান্য কিছু খরচ দেবেন, ঠিক করে দেব।’ কথার ফাঁকে আমি বললাম, ‘আমার আর্জেন্ট পাসপোর্টের প্রয়োজন ছিল।’
সাথে সাথে ওই ব্যক্তি জানতে চাইলেন, ‘সুপার এক্সপ্রেস? করে দেওয়া যাবে। ৩০ হাজার টাকা লাগবে।’ এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ ২৫ হাজার টাকায় রাজি হলেন। এভাবে একটি দালালচক্র প্রতিদিন অফিসের আশপাশে অবস্থান নেয়। একসময় লাইনে অবস্থান নিলেও দালালরা এখন একটু দূরে অবস্থান নেয়। যারা দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট করতে চায়, মূলত তাদেরই টার্গেট করে চক্রটি।
আবেদনকারীদের দাবি, পাসপোর্ট অফিসের বাইরে গড়ে ওঠা বেশিরভাগ ফটোকপির দোকানে দালালরা অবস্থান নেয়। ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট হাতে পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখায়। তবে সময় অনুযায়ী তারা টাকার পরিমাণ বাড়ায়-কমায়।
সিলেট পাসপোর্ট অফিসে হয়রানির এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। আবেদনকারীদের কাছ থেকে দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। দালাল ধরতে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। কাউকে কাউকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হলেও বেরিয়ে এসে একইভাবে কাজ করে তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অফিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, দালালদের কারণে অফিসের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। তবে অনেকেই বলছেন, এই সেবা কার্যক্রমে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হলে আবেদনকারীদের হয়রানি বন্ধ হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক (তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা) এ কে এম মোতাহার হোসেন জৈন্তাবার্তাকে বলেন, আবেদনকারীকে অনলাইনে আবেদন ফরম পূরণ করতে হয়। তবে অধিকাংশ পাসপোর্ট প্রত্যাশীর অনলাইনে আবেদন করার অভিজ্ঞতা নেই। ফটোস্টেট-ফটোকপির দোকানে গিয়ে কম্পিউটারে ফরম পূরণ করতে হয়। এসব ব্যক্তি খেয়ালখুশিমতো অর্থ দাবি করে। অনেক সময় ভুল তথ্য দিয়ে ফরম পূূরণ করে দেয়। ব্যাংক ফি গ্রহণ করে তা পরিশোধ না করেই আবেদনকারীকে অফিসে পাঠিয়ে দেয়। এভাবে সেবা প্রার্থী হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হন।
আর দালাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেখেন, বেশিরভাগ পাসপোর্ট প্রত্যাশীর অনলাইনে আবেদন করার অভিজ্ঞতা নেই। মূলত তারাই ফটোস্টেট-ফটোকপির দোকানে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়েন। এখানে তো আমাদের করার কিছু নেই।’
জৈন্তাবার্তা / রহমান
